গর্ভাবস্থায় হলুদ স্রাব

গর্ভাবস্থায় হলুদ স্রাব

গর্ভাবস্থার সাথে জড়িত থাকতে পারে কিছু বিস্ময়কর এবং ভয়ের অভিজ্ঞতা।আপনার দ্রুত শারীরিক পরিবর্তনের সাথে এবং আপনার হরমোনগুলি তাদের কাজের সামঞ্জস্য রক্ষার মাঝে আপনাকে আপনার শরীর থেকে অনেক অপ্রীতিকর প্রতিক্রিয়াগুলির সাথে নিজেকে লড়াই করতে দেখতে হতে পারেসেগুলির মধ্যে একটি হল তরল এবং স্রাব যা আপনার যোনির মাধ্যমে আপনার শরীর থেকে নির্গত হয়।প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থায় যোনি থেকে হলুদ স্রাব নিঃসরণের অনেকগুলি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে।এটা একটা সংক্রমণের ফলে হতে পারে,সেটা যদি চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা হয়,সেটি আপনার সার্ভিক্সের মাধ্যমে অমরা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অ্যামনিওটিক তরলকে সংক্রমিত করতে পারে।

হলুদ স্রাব কি?

গর্ভাবস্থায় আপনার হরমোন স্তরের পরিবর্তন শরীরের মধ্যে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধিকে অন্তর্ভূক্ত করে।এটি আপনার যোনিতে অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহ ঘটায় লিউকোরিয়ার কারণে(গর্ভাবস্থাকালে যোনি থেকে নিঃসৃত স্রাব)।সার্ভিক্সের পাশাপাশি যোনির নিঃসরণে এই স্রাবটি গঠিত হয়,যোনির প্রাচীর থেকে স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়াল ফ্লোরা এবং পুরাতন যোনি কোষ দ্বারা।স্রাবের পরিমাণ এবং তীব্রতা প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়।

গর্ভাবস্থাকালে হলুদ স্রাব হওয়া কি স্বাভাবিক?

যোনি স্রাব হল যোনিকে পরিষ্কার রাখার জন্য দেহের নিজস্ব একটি কৌশল,এই পদ্ধতিতে যোনির মাধ্যমে যোনি মধ্যস্থ মৃত কোষ এবং ব্যাকটেরিয়াগুলি বাইরে বের করে দিয়ে যোনিকে পরিষ্কার এবং সুস্থ রাখে।লিউকোরিয়া,যেটি হল যোনি শ্লেষ্মার একটি বর্ধিত পরিমাণ,গর্ভাবস্থার খুব সাধারণ একটি লক্ষণ।এই নিঃসৃত স্রাবের পরিমাণ চূড়ান্তে পৌঁছাবে গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে।যদি স্রাবে দুর্গন্ধ থাকে এবং ঘন রঙ হয়ে ওঠে,তখন সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারকে দেখানোর প্রয়োজন।

গর্ভবতী মহিলাদের হলুদ স্রাব হওয়ার কারণগুলি কি?

উচ্চ মাত্রার ইস্ট্রোজেন ছাড়াও উজ্জ্বল হলুদ স্রাব হওয়ার জন্য আরও বেশ কিছু অন্যান্য কারণ আছে,যা দেখা যেতে পারে আপনি গর্ভবতী হওয়ার সময়।

1.ইস্ট্রোজেনের প্রকটতা

উচ্চ মাত্রায় ইস্ট্রোজেনের অর্থ হল প্রচুর পরিমাণে যোনি স্রাব।ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অন্যান্য যে কারণগুলি আছে সেগুলি হল দেহের অতিরিক্ত ফ্যাট বা মেদ, স্ট্রেস, কম তন্তুযুক্ত ডায়েট বা এমনকি দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থাআপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন যদি ইস্ট্রোজেনের প্রকটতার কারণে অস্বাভাবিক স্রাব হয়ে থাকে।

2.ইস্ট সংক্রমণ

গর্ভধারণের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ইস্ট সংক্রমণ সাধারণ একটা ব্যাপার যেহেতু হরমোনগুলি যোনির pH স্তরকে প্রভাবিত করে,ক্যানডিডা অ্যালবিক্যান নামে ইস্টের বৃদ্ধি ঘটায়।এই কারণে ঘন,সাদা,দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব,যোনি চুলকানি,লালচেভাব এবং ভালভা বা যোনিদ্বার ফুলে ওঠাএগুলি ঘটে থাকে।শ্লেষ্মার রঙটি প্রতি মহিলার ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে।আপনার চিকিৎসক এমন কিছু ওষুধ দিতে পারেন যা শীঘ্রই সংক্রমণটি দূর করবে,এবং তাতে আপনার সন্তানের কোনওরকম ক্ষতিসাধন হবে না।

3.ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনসিস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে যোনির সংক্রমণ

যখন যোনির অভ্যন্তরস্থ ভাল এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনসিস হয়।ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলি খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু যখন খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলির সংখ্যা ভাল গুলির তুলনায় বেড়ে যায়,তখন ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনসিস হয়।এটি চুলকানি এবং ফোলা সহ একটি হলুদসবুজ, ঘন এবং দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।যদি সঠিক সময়ে এটির চিকিৎসা করা না হয়ে থাকে তবে এটি থেকে অকাল প্রসব,কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং এমনকি গর্ভাবস্থার পরে জরায়ুতে সংক্রমণও হতে পারে

4.যৌন সংসর্গ জনিত রোগ(STDs)

অস্বাভাবিক স্রাবের সবচেয়ে বেশী সাধারণ কারণের ফলে, মা এবং শিশু উভয়ের ক্ষেত্রেই এসটিডিগুলি খুব বেশি ঝুঁকি নিয়ে থাকে সঠিক সময়মতো এগুলির চিকিৎসা না করা হলে এগুলির কারণে ঝিল্লি অকালে ফেটে যেতে পারে, অকাল প্রসব ঘটতে পারে এবং এমনকি কম ওজনের শিশুর জন্ম হতে পারে যে প্রধান এসটিডিগুলির কারণে অস্বাভাবিক স্রাব হয়ে থাকে সেগুলি হল ট্রাইকোমোনিয়াসিস, ক্ল্যামিডিয়া এবং গনোরিয়া

যৌন সংসর্গ জনিত রোগ(STDs)

কখন চিন্তা করবেন

উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়াও,আরও অন্যান্য কিছু STD গুলির দ্বারা আপনি সংক্রমিত হতে পারেন,যেগুলিকে জ্বালা করা,চুলকানো অথবা অস্বস্তির দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না।অপ্রীতিকর দুর্গন্ধযুক্ত ধূসর, সবুজ, হলুদ স্রাবের যে কোনও দৃশ্য অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে

হলুদ স্রাবের চিকিৎসা কীভাবে করা যেতে পারে?

এক্ষেত্রে এমন কিছু ব্যবস্থা রয়েছে যা স্রাবের ফলে হওয়া কিছু পরিমাণ অসুবিধাকে হ্রাস করতে সাহায্য করে থাকে।

হলুদ স্রাবের ঘরোয়া প্রতিকার সমূহ

  • প্যান্টি লাইনারগুলি স্রাবের শোষণের জন্য আদর্শ যদি সেটি কোনও সংক্রমণের কারণে না হয়ে থাকে।
  • যোনি অঞ্চলটিকে পরিষ্কার,স্বাস্থ্যকর এবং ঝরঝরে রাখুন।আপনার কাজটি সারার পর অঞ্চলটিকে সর্বদা সামনে থেকে পিছনের দিকে মুছে নেওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করুন।অন্য উপায়ে অঞ্চলটিকে মোছার ফলে আপনার যোনিতে জীবাণু প্রবেশ করে যেতে পারে।
  • অতিরিক্ত আরাম এবং বায়ু চলাচলের জন্য সুতির প্যান্টি পরিধান করুন।যদি সংক্রমণ হয়েছে বলে আপনি সন্দেহ করে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে সর্বদা সিন্থেটিক উপকরণ ত্যাগ করুন।
  • সুগন্ধি সাবান,প্যাড এবং টয়লেট পেপার,হাইজিন স্প্রে এবং টাইট ফিটিং প্যান্ট ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
  • ডাচিং থেকে সর্বদা দূরে থাকুন কারণ এটি যোনির সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার ফ্লোরাকে নষ্ট করে দেয় এবং সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

গর্ভাবস্থাকালে কীভাবে আপনি হলুদ স্রাব রোধ করতে পারেন

  • যৌনাঞ্চল সর্বদা পরিষ্কার এবং শুকনো রাখুন।
  • ত্বকে ঘষা লাগবে না এমন ঢিলেঢালা পোশাক এবং অন্তর্বাস পরিধান করুন।
  • সংক্রমণ কমাতে যোনি ডাচিং এড়িয়ে চলুন।
  • একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন এবং প্রচুর পরিমাণ দই খাবারের সাথে যোগ করুন।
  • অতিরিক্ত স্রাবের কারণ মানসিক চাপও হতে পারে।যোগা,ধ্যান,ব্যায়াম,সঠিক খাদ্য ইত্যাদি প্রয়োগের মত বিভিন্ন উপায়ের দ্বারা নিজেকে চাপ মুক্ত করুন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

নীচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন দেওয়া হল যেগুলি মানুষের মধ্যে থেকে থাকতে পারেঃ

1. হলুদ স্রাব কি গর্ভাবস্থার লক্ষণ হতে পারে?

যখন যনি স্রাব হলুদ হয়,এটা সাধারণত দুধরণের হতে পারেঘন অথবা পাতলা জলের ন্যায়।দ্বিতীয়টি সংকেত দেয় যে কোনও মহিলার মাসিক শুরু হতে চলেছে,আর হলদেটে আভাটি আসে ঋতুস্রাবের প্রাম্ভিক রক্ত থেকে।যাইহোক,যদি কোনও মহিলা তার মাসিক শুরু হওয়ার আর অন্য কোনও লক্ষণের প্রকাশ লক্ষ্য করতে না পারেন তবে এর অর্থ এও হতে পারে যে তার কোনও সংক্রমণ রয়েছে।

যখন স্রাব ঘন হয়,তবে এর অর্থ হতে পারে হয় মাসিকের সূচনা অথবা আবার এটির মানে গর্ভাবস্থার প্রাম্ভিক লক্ষণও হতে পারে।এই ক্ষেত্রে হলদেটে আভাটা বেড়ে উঠতে পারে ঘটে থাকা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার কারণে।গর্ভধারণের একটা পরীক্ষা করিয়ে নিলে তা আপনাকে এ ব্যাপারে সহজে নিশ্চিত হতে সাহায্য করবে।

2.গর্ভাবস্থাকালে হলদেটেসাদা স্রাব কি স্বাভাবিক?

কোনও রকম গন্ধ ছাড়া এবং ডিমের সাদা রঙের সামঞ্জস্যের সাথে একটি হলদেটেসাদা স্রাব গর্ভাবস্থায় কিছুটা স্বাভাবিক

3.গর্ভধারণকালীন সময়ে গন্ধহীন হলুদ স্রাব হওয়া কি ঠিক?

সাধারণত,স্রাব সাদা অথবা হালকা হলুদ হয়ে থাকে।কিন্তু যদি সেটি অপেক্ষাকৃত গাঢ় রঙের হয়ে থাকে এবং দিনে দিনে তা আরও গাঢ় হয়ে উঠতে শুরু করে তবে একজন ডাক্তারের মতামত অবশ্যই নিতে হবে।স্রাবের রঙটি যদি লক্ষ্য রাখা হয় তবে তা সবচেয়ে ভাল হয়,কারণ এর ফলে ডাক্তারের কাছেও আরও বেশি তথ্য থাকবে যা তাঁকে সঠিক সমস্যা খুঁজে বের করে তার সঠিক চিকিৎসা করতে সাহায্য করবে।

4. দুর্গন্ধের সাথে ঘন হলুদ স্রাব কি কোনও রোগের লক্ষণ হতে পারে?

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই,হ্যাঁ,দুর্গন্ধের সাথে ঘন হলুদ স্রাব একটি সংক্রমণ অথবা রোগেরই লক্ষণ হতে পারে,এবং এটির জন্য চিকিৎসাগত হস্তক্ষেপের কথাই বলা হয়।

আপনি যখন আপনার যোনি থেকে অপ্রীতিকর স্রাব দেখতে পান তা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় এবং আপনার ডাক্তারের সাথে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও অত্যন্ত বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারেএকটা হালকা যোনি স্রাব যখন ডিমের সাদা অংশের ঘনত্বের ন্যায় সাদা,ক্রীম রঙ অথবা হালকা হলুদ রঙের হয়ে থাকে,সেটি সম্পূর্ণ রূপে স্বাভাবিক।কিন্তু যদি স্রাবটি কিছু অদ্ভুত রঙ ধারণ করে এবং তা থেকে দুর্গন্ধ নির্গত হয় ,সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আপনার অবিলম্বে ডাক্তারী পরামর্শের প্রয়োজন।