শিশুদের প্রস্রাবে রক্ত(হেমাটুরিয়া)

শিশুদের প্রস্রাবে রক্ত(হেমাটুরিয়া)

বাচ্চাদের লাল প্রস্রাব দেখতে পাওয়াটা আপনার কাছে হয়ত কিছুটা বিপদাশঙ্কাপূর্ণ হতে পারে।যখন প্রস্রাবের মধ্যে রক্ত দেখা যায় সেটিকে হেমাটুরিয়া বলা হয়ে থাকে।এটি শিশুদের মধ্যে হয়ে থাকা বেশ সাধারণ একটি ঘটনা।বেশীরভাগ সময়েই,এটি কোনও গুরুতর সমস্যা হয়ে ওঠে না এবং নিজে থেকেই এটি চলে যায়,তবে অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই এটি আবার আরও গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হয়ে থাকে।

হেমাটুরিয়া কি?

কিডনি রক্ত ​​থেকে সমস্ত বর্জ্য এবং তরল অপসারণ করে এবং সেটিই পরিণত হয় প্রস্রাবে, যা পরবর্তীতে মূত্রনালীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, মূত্রাশয়ের সহিত কিডনির সংযোগকারী নলগুলিতে এটি জমা হয় এবং তারপরে প্রস্রাবের আকারে শরীর থেকে মুক্ত হয়।এই প্রক্রিয়াটির যে কোনও মুহুর্তে যদি রক্ত ​​প্রস্রাবের মধ্যে লিক করে তবে এর ফলস্বরূপ হেমাটুরিয়া হয়।

হেমাটুরিয়ার ধরন

এক্ষেত্রে দু’ধরনের হেমাটুরিয় হয়ে থাকে।

1. মাইক্রোস্কোপিক হেমাটুরিয়া

এই ধরনের হেমাটুরিয়া মানব চোখে অদৃশ্য,কারণ এক্ষেত্রে প্রস্রাবের রঙের কোনও পরিবর্তন হয় না,এটি বোঝার একমাত্র উপায় হল প্রস্রাব পরীক্ষা করানোর দ্বারা এর উপস্থিতি আছে কিনা তা জানা।মাইক্রোস্কোপিক হেমাটুরিয়া শরীরে কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে না এবং দেহে যে সেটি ছিল তা মানুষ বুঝতে পারার আগেই সেটি প্রায়শই চলে যায়।

2. গ্রস হেমাটুরিয়া

এক্ষেত্রে প্রস্রাবে রক্তের যথেষ্ট পরিমাণে লোহিত রক্ত কণিকার উপস্থিতি সেটিকে লক্ষ্যণীয়ভাবে লাল বর্ণের করে তোলে।গ্রস হেমাটুরিয়াও আবার কোনও রকম সমস্যার সৃষ্টি ছাড়াই নিজে থেকেই সেরে যায়।তবে এক্ষেত্রে এটি আবার আরও বেশি গুরুতর সমস্যার লক্ষণও হতে পারে এমন সম্ভাবনাও থাকে।

বাচ্চাদের মধ্যে হেমাটুরিয়ার কারণগুলি কি?

বাচ্চাদের হেমাটুরিয়া হওয়ার বহু বিভিন্ন কারণ আছে,সেগুলির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি হল ট্রমা বা শারীরিক অসুস্থতা,সবলে ব্যায়াম করা,মাসিক এবং ভাইরাস জনিত অসুস্থতা যেমন হেপাটাইটিস।এমনকি প্রচুর পরিমাণে রঞ্জক পদার্থযুক্ত খাদ্য গ্রহণ,যেমন বীটরুট এবং লাল রঙ সমৃদ্ধ খাবারগুলিও অল্প বয়সী বাচ্চাদের প্রস্রাবকে লালচে রঙের করে তুলতে পারে এবং 3 বছর বয়সী বাচ্চাদের প্রস্রাবটি রক্তের ন্যায় দেখাতে পারে।

  • ব্লকড এবং সিস্টিক কিডনিঃ যে কিডনিগুলি অবরুদ্ধ রয়েছে বা যেগুলিতে “সিস্ট” নামক তরলপূর্ণ থলি রয়েছে সেগুলি হেমাটুরিয়ার কারণ হতে পারে।এটি সেই জিনিসই কিনা তা নির্ধারণের একটি উপায় হল একটি আল্ট্রাসাউন্ড করানো।
  • বংশানুক্রমিক রোগঃ পরিবারের রেখা ধরে চলে আসা কিছু বংশগত রোগ আবার এটির কারণ হতে পারে।এই ধরনের কিছু রোগের মধ্যে আছে পলিসিস্টিক কিডনি রোগ, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেফ্রাইটিস, অ্যালপোর্টের সিনড্রোম এবং সিকেল সেল ডিজিজ।
  • অত্যধিক ক্যালসিয়ামঃ প্রস্রাবে উচ্চ মাত্রায় ক্যালসিয়ামের উপস্থিতির কারণেও হেমাটুরিয়া হতে পারে।এই সমস্যাযুক্ত শিশুদের মধ্যে বৃক্কে পাথর বিকাশের ঝুঁকি উচ্চ মাত্রায় থাকে।
  • গ্লোমারুলোনফ্রাইটিসঃ এটি একটি মারাত্মক অসুস্থতা যা সম্ভবত কিডনির যথাযথ ক্রিয়াতে বাধা প্রদান করতে পারে।কিছু ক্ষেত্রে, রক্ত ​​পরীক্ষার দ্বারা গ্লোমারুলোনফ্রাইটিস সনাক্ত করা যেতে পারে, অন্যদিকে যেখানে কিডনি বায়োপসি করানোরও প্রয়োজন হতে পারে।
  • ইডিওপ্যাথিক হেমাটুরিইয়াঃ এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে হেমাটুরিয়ার জন্য পরিচিত সকল সম্ভাব্য কারণগুলি এর জন্য ধার্য পরীক্ষাগুলিতেও ধরা পড়ে না এবং এক্ষেত্রে কিডনির সমস্যার কোনও পারিবারিক ইতিহাসও পাওয়া যায় না অথচ তবুও সেটি দেহের মধ্যে হয়ে থাকে।

বাচ্চাদের মধ্যে হেমাটুরিয়ার লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি

কখনও প্রস্রাবের মধ্যে খুব বেশি রক্তের উপস্থিতি ছাড়া হেমাটুরিয়া খুবই কম নিজে থেকে কোনও উপসর্গ সৃষ্টি করে।এখানে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে এবং প্রস্রাবের প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে,যার ফলে নিম্ন শ্রোণী অঞ্চলে যন্ত্রণা করে।হেমাটুরিয়া সাধারণত নিজেই অন্যান্য সমস্যাগুলির লক্ষণ।

  • গ্লোমারুলোনফ্রাইটিসঃ যদি গ্লোমারুলোনফ্রাইটিসের কারণে হেমাটুরিয়া হয়ে থাকে তবে তলপেট ফুলে যাওয়া,প্রস্রাব হ্রাস পাওয়া এবং উচ্চ রক্ত-চাপের মত কিছু উপসর্গ হতে পারে।
  • কিডনি অথবা মুত্রস্থলীর সংক্রমণঃ সংক্রমণটি কোথায় হয়েছে তার উপর নির্ভর করে,উপসর্গগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে পিঠের মাঝখানের একটা পাশে যন্ত্রণা,হাড় কাঁপানি ঠাণ্ডা লাগা,জ্বর,গা গুলানো এবং বমি হওয়া, কুঁচকিতে অথবা মূত্রস্থলী অঞ্চলের উপরে যন্ত্রণা,প্রস্রাব করার সময় যন্ত্রণা অথবা অস্বস্তিবোধ হওয়া,খুব বেশি ঘন ঘন এবং দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব ত্যাগ।
  • রক্তক্ষরণের ব্যাধিঃ এগুলির কারণে প্রস্রাব সহ সারা শরীর থেকেই অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে।
  • ট্রমা বা শারীরিক অসুস্থতাঃ শারীরিক অসুস্থতার অন্যান্য লক্ষণগুলি যেমন কাটা এবং ক্ষতগুলি উপস্থিত থাকবে।

শিশুদের মধ্যে হেমাটুরিয়া রোগটি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?

মাইক্রোস্কোপিক হেমাটুরিয়ায় আক্রান্ত যে সকল শিশুদের কিডনির কার্যকারিতায় কোনও সমস্যা থাকে না এবং যাদের রক্তচাপও স্বাভাবিক থাকে তাদের বেশ কয়েক মাস ধরে প্রস্রাব পরীক্ষা করানো উচিত। যদি তখনও প্রস্রাবের রক্ত ​​দেখা দেয় তবে প্রস্রাবের প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং ক্রিয়েটিনিনের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।এক্ষেত্রে একটি কিডনি আল্ট্রাসাউন্ডও করিয়ে নেওয়া উচিত।

যে সকল শিশুদের উচ্চ রক্ত-চাপ থাকে,তাদের প্রস্রাবে উচ্চ মাত্রায় প্রোটিনের উপস্থিতি, কিডনি সমস্যার কোনও পারিবারিক ইতিহাস এবং রক্ত পরীক্ষার ফল খারাপ এসে থাকে,তাদের একটি কিডনি বায়োপ্সি করিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

শিশুদের মধ্যে হেমাটুরিয়া রোগটি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?

শিশুদের প্রস্রাবের মধ্যে রক্তের জটিলতাগুলি

হেমাটুরিয়ার জটিলতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ সমস্যাটি হল এর জন্য কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।হেমাটুরিয়া কোনও রোগ নয় বরং এটি নিজেই একটি লক্ষণ বা উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।এর অর্থ হল যেহেতু এটি অনেকগুলি কারণের জন্য হতে পারে তাই প্রতি পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে এর চিকিৎসাও পৃথক হয়ে থাকে।

এর ফলস্বরূপ,রক্তক্ষরণের মূল কারণটিকে খুঁজে বের করার জন্য শিশুদের হয়ত বিরক্তিজনক বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।কিছু ক্ষেত্রে,এটি রোগ নির্ধারণে এবং রক্ত ক্ষরণ ও মূত্রনালীর সংক্রমণের মত ব্যাধির চিকিৎসার সহায়তায় সমর্থ হয়ে থাকতে পারে কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই এর ফলগুলিতে কোনও সমস্যাই দেখা যায় না এবং কোনওরকম চিকিৎসাগত সহায়তা ছাড়াই বাচ্চা স্বাভাবিকভাবেই সেরে ওঠে।

হেমাটুরিয়ার জন্য আপনার সন্তানের কীভাবে চিকিৎসা করবেন?

যেহেতু এটির জন্য কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই,তাই বাচ্চাদের হেমাটুরিয়ার চিকিৎসায় এর অন্তর্নিহিত কারণগুলির দিকে আপনার ডাক্তারবাবু তার মনোযোগ দেবেন।সেই কারণগুলির কয়েকটি হল নিম্নরূপঃ

  • মূত্রনালীর সংক্রমণঃ এটির উপসর্গগুলি সাধারণত ওষুধ শুরু হওয়ার পরেই হ্রাস পায়।মূত্রনালীর সংক্রমণের জন্য এর স্বাভাবিক চিকিৎসা হল অ্যান্টিবায়োটিকগুলির প্রয়োগ।
  • বৃক্কে পাথরঃ যদি অবস্থাটি ভীষণ গুরুতর না হয়ে থাকে,প্রচুর পরিমাণে জল পান এবং সক্রিয় থাকা অন্ত্র থেকে পাথরগুলিকে অপসারিত করতে স্বাভাবিকভাবেই সহায়তা করতে পারে।তবে যদি অবস্থাটি খুব বেশি মারাত্মক হয়ে ওঠে তবে সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবু সম্ভবত এক্সট্রাকোরপোরিয়াল শক ওয়েভ লিথোথ্রিপসি প্রয়োগের চেষ্টা করবেন (যেখানে শক ওয়েভ পাথরটিকে ছোট ছোট টুকরো করার জন্য ব্যবহৃত হয়)। কখনও কখনও আবার অস্ত্রোপচারও করা হয়ে থাকে।
  • কিডনির রোগঃ কিডনির সমস্যা খুবই মারাত্মক হতে পারে এবং এর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন।কিডনির প্রদাহ দূর করা এবং এটি আরও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াকে প্রতিরোধ করাই হল এক্ষেত্রে প্রধান কাজ,কি কারণে সেটি হচ্ছে সেটি কোনও বড় ব্যাপার নয়।
  • বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত ব্যাধিঃ কিডনিতে বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ব্যাপকভাবে করা হয়ে থাকে।উদাহরণ হিসেবে,ফ্যামিলিয়াল হেমাটুরিয়ার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না তবে অ্যালপোর্ট সিনড্রোমের জন্য প্রগাঢ় চিকিৎসা এবং যত্নের প্রয়োজন।

কখন বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন?

কোনও শিশুর প্রস্রাবের সহিত রক্ত নির্গমনের পাশাপাশি তার প্রস্রাবের মধ্যে প্রোটিন থাকলেও তাকে একজন নেফ্রোলজিস্টকে দেখানো উচিত (কিডনির যত্ন নেওয়ার বিশেষজ্ঞ)।বাচ্চাদের মাইক্রোস্কোপিক হেমাটুরিয়ার ক্ষেত্রে যখন সেটি বেশ কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে অথবা এটি উচ্চ রক্ত-চাপ এবং অন্যান্য উপসর্গগুলির সাথে আসে তখন এটি ভয়ের হয়ে ওঠে।

যাদের বৃক্কে পাথর,মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে হেমাটুরিয়া হয়ে থাকে,সেক্ষেত্রে নিয়মিত যোগ-ব্যায়ামের অনুশীলন এবং ধ্যানের দ্বারা সেটিকে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলার খুব ভাল সম্ভাবনা আছে।বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, গ্লোমিরুলোনফ্রাইটিসের ফলে হেমাটুরিয়া হয়ে থাকে যা স্ট্রেপ সংক্রমণের পরে অথবা যাদের হালকা ধরনের অসুস্থতা থেকে থাকে তাদের মধ্যে বিকাশ পায়।এক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হওয়া সম্ভব।যাদের অবস্থা আরও গুরুতর সেক্ষেত্রে তাদের আরও প্রগাঢ় স্বাস্থ্য সেবার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করতে হবে।