যক্ষা একটি বিশ্বব্যাপী মহামারী যেখানে প্রতি বছর প্রায় দশ মিলিয়নেরও বেশি লোক সংক্রামিত হয়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গণনা অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ টিবি ব্যাকটিরিয়াটিকে সুপ্ত আকারে বহন করে চলে।এই ধরনের নির্লজ্জ পরিসংখ্যানের সাথে, আমাদের বাচ্চারাও কি এই রোগের প্রতি সংবেদনশীল এবং তাই যদি হয় তবে আমরা কীভাবে তাদের রক্ষা করব?এই ধরণের কিছু প্রশ্নের উত্তর আমরা এই নিবন্ধে দিতে চলেছি।
যক্ষা বা টিবি হল এক ধরণের ব্যাধি যা মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলিসিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে।এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং বাতাসের মাধ্যমে একজনের থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যখন সংক্রামিত ব্যক্তিটি হাঁচেন অথবা কাশেন।এটি প্রাথমিকভাবে ফুসফুসে প্রভাব ফেলে যদিও এর পাশাপাশি এটি বৃক্ক এবং মস্তিষ্কের মত দেহের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আক্রমণ করে তার উপর ভিত্তি করে যক্ষা বা টিবিকে বিভিন্ন ধরণে ভাগ করা হয়ঃ
একটি নতুন ঘটনা হল মাল্টি ড্রাগ–প্রতিরোধী যক্ষা বা MDR টিবি।সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার সস্তায় ওষুধ সরবরাহ করার দ্বারা টিবি নির্মূল করার যুদ্ধ ক্ষেত্রে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, অনেক রোগীই নিয়মিত ভাবে ওষুধগুলির ব্যবহার অব্যহত রাখেন না এবং যখনই তারা কিছুটা ভালো বোধ করেন সেই ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন।এটি জীবিত ব্যাকটেরিয়াগুলিকে শক্তিশালী করে তোলে আর সেগুলির বৃদ্ধি পরবর্তীক্ষেত্রে ঐ সকল ওষুধ দিয়ে আর প্রতিরোধ করা যায় না, যা চিকিৎসা প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে তোলে।
শিশুদের টিউবারকিউলিসিসও প্রাপ্ত বয়স্কদের যক্ষার অনুরূপ এবং এটিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে, যেগুলি হলঃ
এটি হল প্রাথমিক পর্যায়, যখন সংক্রামক কোনও ব্যক্তির থেকে শিশুর মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে।
এটি হল একটি সুপ্ত পর্যায়, যখন শিশুর মধ্যে কোনওরকম লক্ষণ প্রকাশ পায় না কিম্বা তারা সংক্রামকও হয়ে ওঠে না।এই পর্যায়ে স্বাস্থ্যে অনাক্রম্যতার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে কারণ শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যুক্ত ব্যক্তি এই সংক্রমণটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে।গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষের মধ্যে এই প্রচ্ছন্ন বা সুপ্ত টিবি রয়েছে।
এটি আবার সক্রিয় পর্যায় নামেও পরিচিত, এটি হল সেই সময় যখন ব্যাকটিরিয়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গাণু এবং কলাগুলির ক্ষতি সাধন করা শুরু করে।
শিশুদের ফুসফুসের যক্ষার কারণ হল মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলিসিস, এটি হল এমন একটি ব্যাকটিরিয়া যা ফুসফুস এবং বৃক্কের মতো অঙ্গাণুগুলিকে আক্রান্ত করে।সংক্রমণটি একজন সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে পারে।
যদিও এমন অনেক বাচ্চা থাকতে পারে যাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন বা সুপ্ত টিবি রয়েছে, তবে সক্রিয় টিবিতে বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় সেই সকল শিশুদের ক্ষেত্রে যাদের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি রয়েছেঃ
টিবি একবার সক্রিয় হয়ে উঠলে যে লক্ষণগুলি দেখা যায় সেগুলির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছেঃ
যদি উপরের উপসর্গগুলি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবু সম্ভবত আপনার শিশুর জন্য একটি ম্যানটউক্স টিউবারকিউলিন স্কিন টিবি পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।এই পরীক্ষাটিতে সামাণ্য পরিমাণে টিবি অ্যান্টিজেনকে ত্বকের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, সাধারণত সেটি বাহুতেই দেওয়া হয়ে থাকে।যদি দুদিন পর সেখানে একটি লাল ফুসকুড়ি মত দেখা দেয়, সেটি শিশুটির টিবি হওয়াকে নিশ্চিত করে।এটি একটি প্রমাণ মানের পরীক্ষা যা স্ক্রীনিং পরীক্ষার একটি অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়।দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি এমন কোনও তথ্য দিতে পারে না যে আপনার শিশুটি কতদিন ধরে টিবিতে ভুগছে।এমনকি এটি প্রচ্ছন্ন বা সুপ্ত টিবি নির্ধারণেও অক্ষম।টিবির উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের জন্য অনুসরণকারী পরীক্ষা হিসেবে একটি চেস্ট রেডিওগ্রাফি করানো যেতে পারে।
টিবি রোগটি ধরা পড়ার সাথে সাথেই তার চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া উচিত। ব্যবহৃত চারটি টিবি ড্রাগের মধ্যে রয়েছে আইসোনিয়াজাইড, রিফাম্পিসিন, পাইরাজিনামাইড এবং এথামবুটল।অ্যান্টিবায়োটিকগুলি কখন গ্রহণ করা হয় তার উপর ভিত্তি করে এটি চিকিৎসা করার প্রয়োজনীয় সময়টিরও পরিবর্তিন ঘটে।কোনও অবস্থাতেই ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয় কারণ তা তবে ব্যাকটেরিয়াগুলিকে ওষুধ প্রতিরোধী করে তোলে।ওষুধ প্রতিরোধী টিবি বা যক্ষা চিকিৎসা করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে এবং নিরাময় হতে আরও বেশি সময় লাগে।
বাড়িতে টিবির যত্ন তথা চিকিৎসার জন্য আপনাকে দ্বিমুখী কৌশল অবলম্বন করতে হবে।প্রথমত আপনাকে রোগটির বিস্তার আটকাতে হবে এবং দ্বিতীয়ত আপনাকে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রোগটির সংক্রমণ রোধ করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপঃ
ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপঃ
যক্ষা বা টিউবারকিউলিসিস কিন্তু মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে যদি যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা না হয়।নিম্নলিখিত ভেষজ প্রতিকারগুলি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও কিন্তু শিশুরা তাদের ওষুধ গ্রহণ করা বন্ধ করতে পারে না।এছাড়াও আবার নিম্নোলিখিত প্রতিকারগুলি প্রয়োগ করা শুরু করার পূর্বে আপনার ডাক্তারবাবুর কাছে তা একবার পরীক্ষা করিয়া নেওয়া উচিত।
রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন এবং আজোইন, এই দুটোই মাইব্যাকটেরিয়ামের প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিচিত।যদিও অ্যালিসিন মুক্ত মূলকগুলির ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিহত করে, তবে ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ রূপে কোষ কাঠামো গঠিত হওয়ার সামর্থ্যের উপর আজোইনের একটি বিরূপ প্রভাব রয়েছে।
গ্রীন টি–র মধ্যে রয়েছে উচ্চ সংখ্যায় পলিফেনল যা টিউবারকিউলিসিস ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে প্রশমিত করে।এটি শুধুমাত্র টিবি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকেই বাধা প্রদান করে না, এটি কিন্তু আবার টিবির ব্যাকটেরিয়াকে দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া রোধ করতেও সহায়তা করে।
যক্ষা বা টিবি থেকে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির জন্য ভারতীয় গুজবেরি বা আমলকিগুলির একসাথে দুটি উপকারিতা আছে কারণ এগুলি এর উপসর্গগুলিকে দূর করার সাথে সাথে এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও সহায়তা করে, যার কারণ মূলত আমলকি মধ্যস্থ এর প্রদাহ বিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়া বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, হলুদে উপস্থিত একটি পদার্থ, কারকিউমিনের বৈশিষ্ট্যটি এক প্রকার রোগ প্রতিরোধক কোষ ম্যাক্রোফেজগুলিকে সক্রিয় করতে সহায়তা করে।দেখা গেছে এই ম্যাক্রোফেজগুলি পরীক্ষাগারের পরিবেশে সমস্ত টিবি ব্যাকটেরিয়াকে সফলভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।কিছু বৈজ্ঞানিক আবার এমনকি মারাত্মক মাল্টি ড্রাগ প্রতিরোধী টিবি-র বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে হলুদের সামর্থের ব্যাপারে নিশ্চিত।
যক্ষার ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।সুতরাং সুরক্ষা গড়ে তোলার সবচেয়ে সেরা সমাধান হল এমন ধরণের খাদ্যগুলি গ্রহণ করা যেগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি সাধনে সহায়তা করে।আর সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
উপরে উল্লিখিত কোনও লক্ষণ বা উপসর্গগুলি আপনার শিশুর মধ্যে দেখা দেয় কিনা সে ব্যাপারে আপনার সজাগ দৃষ্টি বজায় রাখুন।জ্বর, দুর্বলতা, কাশির মত তালিকাবদ্ধ বেশিরভাগ উপসর্গগুলিই সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণও হয়ে থাকতে পারে।তবে সেগুলি যদি কিছু দিনের পরেও অব্যহত থেকে যায়, বাচ্চাকে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
টিউবারকিউলিসিস বা যক্ষা সারা বিশ্ব ব্যাপী ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং এর মৃত্যুর ঝুঁকিও উচ্চ, বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে।তবে প্রথম থেকেই অবিচ্ছন্ন ভাবে যথাযথ চিকিৎসা করালে তার অত্যন্ত ভাল প্রতিক্রিয়া মেলে এবং এক্ষেত্রে কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ শিশু আরোগ্যলাভ করে।