বাচ্চাদের বা নবজাতকের ঘুমের ভঙ্গি ভুল হলে কখনও কখনও এসআইডিএস (আকস্মিক শিশু মৃত্যুর সিন্ড্রোম) হতে পারে। শিশুদের এসআইডিএস দমবন্ধ হয়ে যাওয়া বা রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে। আপনার যদি বাড়িতে বাচ্চা থাকে, তা হলে আপনার সন্তানের জন্য আদর্শ ঘুমের ভঙ্গিগুলির সম্পর্কে এবং কীভাবে কিছু ঘুমানোর ভঙ্গি নবজাত শিশুদের হঠাৎ করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে তা জানা জরুরি।
আপনি বিভিন্ন ভঙ্গিতে শিশুদের ঘুমাতে দেখে থাকতে পারেন। এগুলির মধ্যে কয়েকটি ভঙ্গি শৈশবে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায় (এসইউডিআই)। এসইউডিআই একটি বিস্তৃত শব্দ যার মধ্যে শিশুদের সকল ধরনের আকস্মিক মৃত্যু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন এসআইডিএস যা সাধারণত নবজাতকের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে।
এখানে কয়েকটি নিরাপদ এবং বিপজ্জনক শিশুর ঘুমের ভঙ্গি সম্বন্ধে বলা হল যা সমস্ত বাবা-মা এবং শিশুর পরিচর্যাকারীর অবশ্যই জানা উচিত।
বাচ্চাদেরউপুড়হয়েঘুমানোনিম্নলিখিতকারণগুলিরজন্যঅত্যন্তবিপজ্জনকঃ
তবে, কখনও কখনও, কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসার ক্ষেত্রে, ডাক্তার শিশুকে উপুড় করে ঘুমাতে দেওয়ার জন্য পিতামাতাকে পরামর্শ দিতে পারেন। সাধারণত, গ্যাস্ট্রোইসোফেজাল রিফ্লাক্স থেকে ভোগা বা পিয়ের রবিন সিনড্রোমের মতো কিছু উচ্চ শ্বাসপথের গঠনগত সম্যস্যা থেকে ভোগা বাচ্চাদের এই অবস্থানে ঘুমাতে পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে সাম্প্রতিক গবেষণা এই যুক্তি সমর্থন করে না। অতএব, বাচ্চাকে উপুড় হয়ে ঘুমাতে দেওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে সঠিকভাবে পরামর্শ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
চিত হয়ে ঘুম সবচেয়ে নিরাপদ এবং শিশুর জন্য সেরা ঘুমের ভঙ্গি। এটি শিশুদের জন্য সর্বাধিক প্রস্তাবিত ঘুমের ভঙ্গি কারণ এটি বাতাস চলাচলের পথকে খোলা রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনআইসিএইচডি (শিশু স্বাস্থ্য ও মানব উন্নয়নের জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান) শিশুদের ছোট ছোট ঘুমের পাশাপাশি সারা রাত ধরে গভীর ঘুমের জন্যও চিত হয়ে ঘুমানোর ভঙ্গির সুপারিশ করে।
সংশ্লিষ্টঝুঁকি
দীর্ঘ সময় ধরে চিত হয়ে একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকলে, শিশুরা ‘পজিশনাল প্লাগিওসেফালি’ থেকে ভুগতে পারে, যেটিতে মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যায়, অথবা শিশুটি ‘ব্র্যাকিসেফালি’ থেকেও ভুগতে পারে যেটিতে পিঠ চ্যাপ্টা হয়ে যায়। কিন্তু এইগুলি হল অস্থায়ী অবস্থা এবং শিশুর এক বছর বয়স হলেই খুলি ও পিঠ উভয়েরই আকৃতি স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং কোনও চিকিৎসার প্রায় প্রয়োজনই হয় না। কিছু কৌশল এই দুটি অবস্থাই সম্পূর্ণরূপে এড়াতে সাহায্য করতে পারে।
পাশ ফিরে ঘুমানোর ভঙ্গি শিশুদের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ শিশুটি ঘুমন্ত অবস্থায় ঘুরে গিয়ে উপুড় হয়ে যেতে পারে এবং এটি এসআইডিএস-এরঝুঁকিবাড়ায়।
এখানে আপনার বাচ্চাদের একটি গভীর এবং ভালো রাত্রি ঘুমের জন্য কিছু কৌশল দেওয়া আছে।
অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের জন্য নরম গদি নির্বাচন করার ভুল করেন। এটি করা চলবে না। বাচ্চাদের দৃঢ় বিছানাতে ঘুমাতে দেওয়া আবশ্যক। এছাড়াও, বাচ্চাদের গদিতে বাম্পার প্যাড, বালিশ বা নরম-খেলনা রাখা চলবে না কারণ এগুলি ঘটনাক্রমে শিশুর মাথা ঢেকে দিতে পারে।
লেপ এবং কমফর্টারের মতো সামগ্রী গদির উপর ব্যবহার করলে তা বিছানাকে নরম করবে যা এড়ানো উচিত। এগুলি ব্যবহার করলে বাচ্চারা বিছানার মধ্যে ডুবে যেতে পারে যা শিশুটির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শুধু বিছানাতে একটি পরিষ্কার, সঠিক মাপের গদি রাখুন এবং এটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাদর দিয়ে ঢেকে দিন, এবং এটি আপনার শিশুর আরামদায়ক ঘুমানোর জন্য যথেষ্ট।
কম্বল যেন শুধুমাত্র শিশুর বুক পর্যন্ত আবৃত করে। শিশুর হাতদুটি যেন কম্বলের বাইরে থাকে যাতে কম্বলটি গুটিয়ে গিয়ে শিশুর মাথা ঢেকে না দেয়, কারণ সেটি হলে শিশুর দমবন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঘাড়ের সাথে সঠিকভাবে ফিট করে এবং হাত বার করার ছিদ্র যুক্ত ঘুমানোর ব্যাগ বাজারে পাওয়া যায় এবং এগুলি ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।এগুলি নিরাপদ এবং শিশুকে উষ্ণও রাখে।
ভালো রাত্রি ঘুমের জন্য শিশুকে হালকা জামাকাপড় পরানো দরকার।
এটিও সুপারিশ করা হয়েছে যে শিশুদের শীতল পরিবেশে ঘুমানো উচিত, বিশেষ করে 20 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে।
আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিকস (এএপি) সুপারিশ করে যে শিশুদের ঘুমের ঠিক আগে চুষি দেওয়া যেতে পারে। তবে, চুষি ব্যবহার করার জন্য নবজাতকদের বাধ্য করা ঠিক না। আপনি এটি দেওয়ার চেষ্টা করার আগে তাদের অন্তত 4 সপ্তাহ বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
পিতামাতা, ভাইবোন বা শিশুর যমজের সাথেও বিছানা ভাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয় না। শিশুর সাথে একসাথে–ঘুমের ফলে এসআইডিএস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। ঘুমের সময়, আপনার হাত বা স্তন বা আপনার জামাকাপড় আপনার শিশুটির মুখ ঢেকে ফেলতে পারে এবং বাচ্চার দমবন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতে, শিশুর সাথে ঘুমানো সাধারণ নিয়ম, কারণ এর ফলে রাতে শিশুটিকে খাওয়ানো সহজ হয়। কিন্তু এখন আপনি জানেন যে কেন এটি এড়ানো উচিত!
পিতামাতারঘরেইবাচ্চাদেরবিছানাটিস্থাপনকরাজরুরী।এটিবুকেরদুধখাওয়ানোকেসুবিধাজনককরেতোলেএবংপিতামাতারপক্ষেশিশুরঘুমেরভঙ্গিরউপরনজররাখাসহজহয়।ঘরভাগাভাগি নাকরাএবংবিছানাভাগাভাগিকরাহচ্ছেএএপিদ্বারাসুপারিশ করা একটিশিশুরঘুমেরসুরক্ষানির্দেশিকা।
আগে যেমন আলোচনা করা হয়েছে যে বাচ্চাদের উপুড় হয়ে ঘুমানোর সুপারিশ করা হয় না। কিন্তু শিশুরা 4 থেকে 5 মাস বয়সী হলে, তারা চিত হওয়া অবস্থা থেকে উল্টে উপুড় হতে পারে, এটি একেবারে স্বাভাবিক। এই সময়ের মধ্যে, শিশুদের এসআইডিএস-এর ঝুঁকি হ্রাস পায়, এবং তাই শিশুকে তার নিজের আরামদায়ক ভঙ্গি খুঁজে নিতে দেওয়া যায়। একটি 5 মাস বয়সী শিশু তার মাথা পাশের দিকে ফেরাতে পারে এবংশ্বাস- প্রশ্বাসের জন্য মুখ ও নাক খোলা রাখতে সক্ষম হয়। তবে, শিশুর ঘুমন্ত অবস্থায় নজর রাখা উচিত এবং তাকে ঘুম পাড়াবার সময় চিত করিয়ে শোয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
দয়া করে মনে রাখবেন যে শিশুদের শুধুমাত্র 4 মাস বয়স পর্যন্ত উপুড় হয়ে ঘুমানোর সময় সিআইডিএসের ঝুঁকি বেশি থাকে, তবে 12 মাস বয়স হওয়া পর্যন্তও এটি একটি বড় ভয়ের কারণ।
শিশুদের পাশ ফিরে শোওয়া ততটা বিপজ্জনক নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখায় যে, যে শিশুরা পাশ ফিরে ঘুমায় তারা অবশেষে উপুড় হয়ে যায় এবং এটি এসআইডিএসের ঝুঁকি বাড়ায়। বাচ্চারা ছয় মাস বয়সে ঘুরে যেতে শিখে যায় এবং চিত হওয়ার অবস্থান থেকে পাশ ফেরা অবস্থানে ঘুরে যেতে পারে। যদি এরকম হয়, তবে আপনি শিশুটিকে পাশ ফিয়ে শুয়ে থাকতে দিতে পারেন কারণ ঘুরে যাওয়া থেকে বোঝা যায় যে তার আভ্যন্তরীণ অঙ্গ শক্তিশালী হয়েছে এবং দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার কম ঝুঁকি আছে। তবে, ছয় মাস বয়সের আগে যদি শিশুটি পাশ ফিরে যায়, তবে অবশ্যই আপনি তাকে আবার চিত হওয়ার অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
ফেন্সিং রিফ্লেক্স টনিক নেক রিফ্লেক্স নামেও পরিচিত। এটি ঘুমের সময় শিশুদের দ্বারা প্রদর্শিত অনেক অস্বেচ্ছাকৃত আন্দোলনগুলির একটি। এই ক্ষেত্রে, যখন একটি শিশুকে চিত হয়ে ঘুমাতে দেওয়া হয়, তখন তার মাথা এক পাশে ফিরে যায় এবং হাত ও পা সেই পাশেই প্রসারিত হয়। এটি শিশুকে তার চিত হওয়া অবস্থান থেকে উপুড় হয়ে যেতে বাধা দেয়। উল্লেখ্য, এই স্ব-সতর্কতামূলক আন্দোলনটি 3 থেকে 6 মাসের মধ্যে যে কোনো সময় চলে যাবে।
অনেক ক্ষেত্রে, বাচ্চারা চিত হয়ে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না এবং তাদের গভীর ঘুম না হতে পারে। কিন্তু এসআইডিএস এড়ানোর জন্য, পিতামাতাদের বাচ্চাদেরকে চিত হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করিয়ে দিতে হবে। ধীরে ধীরে তারা মানিয়ে নেবে এবং ঘুমিয়ে পড়বে।
এছাড়াও, নাক বন্ধ হওয়া থেকে ভুগতে থাকা শিশুরা চিত হয়ে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করতে পারে। এই ক্ষেত্রে, শিশুর ঘরে একটি হিউমিডিফায়ার রাখুন। এটি বায়ুকে আর্দ্র করবে এবং নাক বন্ধ হওয়াকে কমাবে।
স্বাস্থ্যবান শিশুদের চিত হয়ে ঘুমানোর সময় সাধারণত দমবন্ধ হয় না। এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে গ্যাস্ট্রোইসোফেজাল রিফ্লাক্স রোগযুক্ত শিশুরাও চিত হয়ে ঘুমালে তাদের দমবন্ধ হয় না। শিশুর মুখের মধ্যে একটি খাওয়ানোর বোতল দিয়ে তাকে যেন ঘুমাতে দেওয়া না হয় সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এটি থেকে দমবন্ধ হওয়ার পাশাপাশি কানের সংক্রমণও হতে পারে।
অকালে জন্মানো শিশুরা এসআইডিএস-এর খুব বেশি ঝুঁকিতে থাকে। অকালে জন্মানো শিশুদেরও চিত হয়ে ঘুমাতে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে খুব বিরল ক্ষেত্রে, যদি শিশুটি তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা থেকে ভোগে, তবে তাকে খুব কঠোর পর্যবেক্ষণের অধীনে উপুড় হয়ে ঘুমাতে দেওয়া যেতে পারে। আসলে, শুধুমাত্র একটি অত্যন্ত ভালোভাবে নিরীক্ষিত ব্যবস্থাতেই এটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা বিভাগের ফেডারেল সংস্থা এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য স্লীপ পজিশনারগুলিকে অনুমোদন দেয় না। শিশুকে চিত হয়ে ঘুমাতে সাহায্য করার জন্য স্লীপ পজিশনার ব্যবহার করা বিপজ্জনক এবং এড়ানো উচিত।
নবজাতক শিশুরা ঘুমের ভুল ভঙ্গির কারণে এসআইডিএস এবং এসইউডিআই প্রবণ হতে পারে। অতএব, নতুন জন্মগ্রহণ করা শিশুদের ঘুমের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং সেগুলি যে ঝুঁকি সৃষ্টি করে তা জানা অপরিহার্য। এই প্রয়োজনীয় তথ্য জানার জন্য সময় দিলে তা আপনার নবজাতককে নিরাপদ এবং সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করবে।