শীতকাল ঘুরে আসার সাথে সাথে আপনার মনে যে সকল মানসিক চিন্তা এসে উপস্থিত হতে পারে এমন বহু জিনিসগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠতে পারে কীভাবে আপনি শীতে আপনার শিশুর উপর ঠান্ডার প্রভাব পড়া থেকে তাকে রক্ষা করবেন।আমরা এখানে পারদ–মাত্রা হ্রাস পাওয়া, ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং তার শেষ পরিণতি সকল ধরনের অস্বস্তি– ঘুমের অভাব–এসবের কথা বলছি! প্রতিদিন রাত্রে আপনার বাচ্চার ভালোমতো ঘুম হওয়া নিশ্চিত করাটা যথেষ্ট কঠিন, তবে শীতল ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া সেই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে আরও কিছুটা জটিল করে তুলতে পারে।যাইহোক, এই সকল টিপসগুলি আপনাকে নিদ্রাহীন রাত্রিগুলি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে এবং বিশ্রাম পাওয়ার উপায় দেখাবে!
শীতকালে আপনার শিশুকে ভালোমতো ঘুম পাড়ানোর 9 টি টিপস
আপনার শিশুর ভালোমতো ঘুম হওয়া নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায়টি হল, সকল ঋতু নির্বশেষে, যথা সময়মতো শয়নকালীন রুটিনটি অনুসরণ করে চলা নিশ্চিত করা।এই উপায়ে আপনার বাচ্চাও জানবে যে এটি তার ঘুমের সময় বা তার শোবার সময় প্রায় আগত, আর তাই তাকে ঘুম পাড়ানোর সময় আর আপনার সে ব্যাপারে খুব বেশি যুদ্ধ তার সাথে করতে লাগবে না।এই রুটিনের সাথেই শুধু আরও কয়েকটা অতিরিক্ত কৌশল যুক্ত করে সেটিকে আপনার শিশুর জন্য আরও শীত–সুলভ একটি রুটিন হিসেবে গড়ে তুলুন।
ঘুমের মধ্যে আপনার বাচ্চার দেহ খুব বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কিনা তা দেখার জন্য তার ঘাড় কিম্বা পেট স্পর্শ করুন।যদি সেগুলি স্পর্শ করে ঠাণ্ডা মনে হয়, সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ আপনার বাচ্চাকে তাপ দেওয়া প্রয়োজন।এছাড়াও আপনার আর কী কী জানা উচিত সে ব্যাপারে জানতে আরও পড়ুন।
1.শুতে যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে সমস্ত উদ্দীপক ক্রিয়াকলাপগুলি করা থেকে পিছুপা হন
টিভি বা মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশনগুলির উচ্চ শব্দ, প্রচুর আলো, সশব্দকারী খেলনা, শক্তি সরবরাহ করে এমন ধরনের খাদ্য– এগুলি হল এমন কিছু বিষয় যা আপনার ছোট্টটিকে জাগিয়ে এবং ধাবমান বা গতিশীল রাখতে পারে।শুতে যাওয়ার প্রায় 2 ঘন্টা আগে থেকেই, এই প্রতিটি জিনিস ধীরে ধীরে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিন বা বন্ধ করুন এবং নিশ্চিত করুন যে শিশুর চারপাশের সমস্ত কিছুই নীরবস্থায় রয়েছে, যেগুলি তাকে উদ্দীপিত করবে না।
2.সঠিক তাপমাত্রা সেট করুন
আপনি কি একথা জানতেন যে আপনার দেহের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা আপনাকে ক্লান্তি ও তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করানোর উপর একটা ভূমিকা রাখে?দিনের বেলায় আপনার দেহের তাপমাত্রা থাকে উচ্চ মাত্রায়, যা আপনাকে বেশ সক্রিয় ও কর্মচঞ্চল বোধ করায়।এই তাপমাত্রাই আবার বিকেলের দিকে কিছুটা কমে যায় যা দিনেরবেলায় হয়ে থাকা অনুভূতির থেকে আপনার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং সূর্যাস্তের পর আপনার আরও বেশী ক্লান্তি বোধ হতে থাকে আর শরীর মেলাটনিন নামক হরমোন নিঃসৃত করে যা আপনাকে ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে।আপনার শিশু যে ঘরে ঘুমায় তার তাপমাত্রা তার দেহের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার পরিপূরক হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সে ঘুমের মধ্যে মারাত্মক ঠাণ্ডা বা গরম বোধ করে মাঝরাতে কাঁদতে কাঁদতে উঠে না পরে।শীতকালে ঘরের তাপমাত্রা প্রায় 23-26 ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখাটাই সবচেয়ে ভাল।আপনার বাচ্চার ঘরে রাখার জন্য হিটারের পরিবর্তে একটা গরম ধোঁয়ার বা ওয়ার্ম মিস্ট হিউমিডিফায়ারকে বেছে নিন।
3.আপনার শিশুকে স্নান করানো এড়িয়ে চলুন
শীতের রাতে আপনার বাচ্চাকে স্নান করানো কোনওভাবেই তাকে আরাম অনুভব করাতে পারে না, এটি কেবলই তাকে উত্তেজিত করে তোলে এবং কষ্ট দেয়! যদি একান্তই তার প্রয়োজন পড়ে তবে সাধারণ স্নানের পরিবর্তে বরং একটা ভিজে ওয়াশক্লথ দিয়ে তার মাথা এবং দেহ মুছে দিয়ে তাকে একবার স্পঞ্জ স্নান করান। শীতের রাতে জলের তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণে খুব বেশি সময় ধরে তাকে স্নান না করানো বা তার গা–হাত–পা ভিজে না রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত হন।
4.আপনার শিশুকে ম্যাসাজ করুন
আপনার শিশুর জন্য ভাল ম্যাসেজের উপকারিতা প্রচুর, তবে বিশেষ করে রাতের বেলায়, একটি আরামদায়ক ম্যাসেজ আপনার শিশুটিকে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে সহায়তা করে।তার স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য (এবং তারপর ঘুমিয়ে পড়ার জন্যও!)ব্যবহার করুন একটা শীতল বাম যেমন ভিক্স বেবিরাব* (এটি 3 মাস বা তার বেশী বয়সী শিশুদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত)যার মধ্যে রয়েছে অ্যালোভেরা এবং নারকেল তেল আর ল্যাভেন্ডার ও রোজমেরির সুগন্ধ যা শিশুকে সহজে ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে।ভিক্স বেবিরাব* বামটি আপনার বাচ্চার গলা, বুক, হাত এবং পায়ের তালুর উপর কেবল হালকা করে ঘষুন।মৃদু চাপের সাথে 10 মিনিটের একটা ম্যাসাজই সেই চমৎকার কৌশলে পরিণত হবে যা আপনার শিশুকে রাত্রে ভালভাবে বিশ্রাম পেতে সাহায্য করবে।
5.কয়েক স্তরের আবরণের দ্বারা তাকে মুড়িয়ে রাখবেন না
যদিও এসংক্রান্ত যুক্তি এমন প্রস্তাব তুলে ধরে যে কয়েক স্তরের আবরণের দ্বারা আপনার বাচ্চাকে জড়িয়ে বা মুড়িয়ে রাখলে তা তাকে উষ্ণ রাখবে, কিন্তু বাস্তবে তা অন্যই হয়।অনেকগুলি স্তরের আস্তরণ আপনার শিশুকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত করে তুলতে পারে, যা তাকে চরম অস্বস্তি বোধ করায় এমনকি এসআইডিএসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে।আপনি যদি ঘুমের মধ্যে আপনার বাচ্চাকে ঘেমে যেতে দেখেন, তার অর্থ হল আপনাকে অবশ্যই তার গায়ের থেকে আস্তরণের কয়েকটি স্তর খুলে সরিয়ে দিতে হবে।আর তার সাথে তাকে খুব বেশী ভারী ও মোটা কম্বল দিয়ে চাপা না দেওয়ার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করুন(এর অন্য আরেকটি কারণ হল এটি তার এসআইডিএস–এর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে)।পরিবর্তে আপনার ছোট্টটিকে একটা আরামদায়ক কাপড় দিয়ে জড়িয়ে মুড়ে রাখুন যা তাকে উষ্ণ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সহায়তা করবে অথবা তাকে পায়জামা জাতীয় পোশাক পরানোর সাথে পায়ে মোজা ও হাতে দস্তানা পরিয়ে দিন।আপনার শিশুকে পোশাক করানোর সময় ‘প্লাস ওয়ান‘ বিধি অনুসরণ করুন অর্থাৎ আপনার নিজের তুলনায় একটি অতিরিক্ত লেয়ার বা স্তর তার পোশাকের সাথে যুক্ত করুন।
6.সামান্য বুদ্ধি কাজে লাগান
দিনের বেলায় আপনার শিশুর ঘরের পর্দাগুলি সরিয়ে দিলে সেখানে পর্যাপ্ত আলো–রোদ প্রবেশ করে ঘরটিকে গরম রাখতে সাহায্য করে।সুতরাং সারাদিন পর্দা সরিয়ে রেখে প্রচুর আলো প্রবেশ করতে দিয়ে ঘরটিকে উজ্জ্বল করে তুলুন কিন্তু রাতের বেলায় পুনরায় পর্দাগুলি যথাস্থানে টেনে দিন।আলো আপনার শিশুর অভ্যন্তরীণ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে এবং ধীরে ধীরে তাকে রাত ও দিনের পার্থক্যের সাথে সামঞ্জস্য করতে সহায়তা করতে পারে।এছাড়াও, যে সমস্ত শিশুরা দিনের বেলা আলোর সংস্পর্শে আসে তারা রাতে আরও ভাল ঘুমাতে সক্ষম হয় কারণ তাদের দেহে মেলাটোনিন নিঃসরণের মাত্রা দিনের বেলায় নিরুদ্ধ হয়ে যাবে, কেবল রাত হলেই তা সর্বাধিক হবে।আলোগুলি কমিয়ে দিলেও সে বুঝতে সক্ষম হবে যে এটি তার ঘুমের প্রায় কাছাকাছি সময় এবং তা তাকে শীঘ্রই স্থির হতে ও তার সাথে সামঞ্জস্য করতে সহায়তা করবে।
7.আপনার বাচ্চাকে ঠিকমতো খাইয়ে নিন
শোয়ানোর সময়, আপনার শিশুকে খাওয়ানোর সেশনগুলির মাঝের সময়কালটির ব্যবধান খর্ব করুন এবং যতটা সম্ভব তাকে ঘুম পাড়ানোর আগেই পেট পুরিয়ে খাইয়ে নিন, যাতে সে তার পেটটিকে বেশ পরিপূর্ণ বোধ করে এবং মধ্যরাতে খাওয়ানোর জন্য কান্নাকাটির দ্বারা আপনাকে ডেকে না তোলে।আর তাকে খাওয়ানোর সময়কালটি আপনি এক ঘন্টা বা তার থেকে আরও কিছুটা কমিয়ে দিন, যাতে সে আবার খুব বেশি পরিপূর্ণ না বোধ করে। প্রতি রাতে একই সময়ে ও একই জায়গায় তাকে খাওয়ানোটাই সবচেয়ে ভাল, যাতে সে তার খাওয়ার সময় এবং জায়গাটির সাথে শোবার সময়টিকেও জুড়ে দিয়ে একটা সামঞ্জস্য তৈরি করতে পারে।
বিঃদ্রঃ – শীতকালে আপনার বাচ্চাকে প্রচুর শাক–সব্জি খাওয়ান।স্যুপ আর স্ট্যু–গুলি হল ঠিক সেই জিনিসটাই যা ডাক্তাররা এই ঠাণ্ডার থেকে একটা উষ্ণ ও আরামদায়ক অনুভূতি পাওয়ার জন্য সেবন করার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন।
8.স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলির দিকে মনোযোগ দিন
শীত সুস্পষ্টভাবেই তার সাথে জড়িত নানা সম্ভাব্য সমস্যাগুলির একটা বড় অংশ সঙ্গে করে নিয়ে হাজির হয়–যার মধ্যে কয়েকটি পরিচিত নাম হল সর্দি, কাশি, রুক্ষ, শুষ্ক ও চুলকানি যুক্ত ত্বক ইত্যাদি।নিরানন্দজনক ও অপ্রীতিকারক এই সকল সমস্যাগুলি আপনার শিশুকে রাতের বেলায় জাগিয়ে রাখতে পারে! আর তার পরিণাম? একটি কাহিল, অস্থির ও বিপর্যস্ত শিশু আর তার সমতুল্য টলায়মান ও কান্ত মা–বাবা! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার শিশুর অস্থিরতা ও অসুস্থতা ধরতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি তা খুব বেশী মারাত্মক না হয়, তবে আপনি তার জন্য উপযুক্ত ঘরোয়া প্রতিকারগুলিকে সর্বদা বেছে নিতে পারেন।তার বুক, গলা এবং পিঠের ওপর ভিক্স ভেপোরাব** (2 বছর বা তার বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত)দিয়ে ম্যাসাজ করার সাথে আপনার স্নেহের স্পর্শ দিয়ে তার বিঘ্নিত ঘুমের যত্ন নিন।মেন্থল, কর্পূর এবং ইউক্যালিপটাস তেলের ঔষধি গুণাবলী তাকে ঘুমাতে এবং স্বস্তি প্রদানে সহায়তা করবে।
9.নিনাদ বা শব্দ বাড়িয়ে দিন
এটি 4 মাসেরও কম বয়সী বাচ্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ককারী তবে অপেক্ষাকৃত বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও খুব খারাপ কাজ করে না! আর হ্যাঁ, আমরা উচ্চস্বর বিশিষ্ট কোনও উত্তেজক শব্দের বিষয়ে কথা বলছি না।আমরা হোয়াইট নয়েজের কথা উল্লেখ করছি, যা আপনার গর্ভে থাকাকালীন আপনার বাচ্চাটির জন্য ব্যবহৃত হত তারই সদৃশ্য।উদাহরণস্বরূপ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারগুলির মতো ছন্দবদ্ধ শব্দগুলি যা ব্যাকগ্রাউন্ডের শব্দগুলিকে আটকায় আর আপনার শিশুকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সহায়তা করে।একটি হোয়াইট নয়েজ মেশিনের জন্য বিনিয়োগ করুন বা আপনার ফোনে এ সম্পর্কিত অ্যাপ্লিকেশনগুলি ইনস্টল করুন।
সবশেষে, আপনার ছোট্টটিকে তার পিঠে ভর দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুম পাড়ান এবং কখনই তার পেটের উপর ভর দিয়ে উপুর করে নয়।কিন্তু তার পরেও যদি ঘুমের মধ্যে আপনার বাচ্চা খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বলে বুঝতে পারেন, তাকে আপনার বুকের কাছে নিয়ে রাখুন এবং আপনার দেহের উষ্ণতা তাকে দিন।এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে আপনার বাচ্চাকে আরাম ও রাত্রিকালীন একটা ভাল ঘুম উপহার দেওয়ার জন্য আপনার স্নেহভরা স্পর্শের মতো আর কিছুই নেই।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ
*অসতর্কতায় বা দুর্ঘটনাক্রমে গভীরে প্রবেশ করা বা হাঁটার সময় পিছলে যাওয়া এড়াতে প্রয়োগের স্থানগুলি হালকা করে আচ্ছাদিত রাখুন।সতর্কতার সাথে নির্দেশাবলী পড়ুন।নির্দেশ অনুসারে ব্যবহার করুন।
** সর্বদা ওষুধের লেবেল পড়ে নিন।শুধুমাত্র নির্দেশ অনুসারেই তা ব্যবহার করুন।লক্ষণগুলি যদি অব্যাহত থাকে তবে তা আপনার ডাক্তারবাবু অথবা একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারকে দেখান।