পেট খারাপ বা ডায়রিয়া হল সেই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পাচনতন্ত্র থেকে বিষক্রিয়া ও ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে যায় । শিশুর মল জলের মতো পাতলা এবং দুর্গন্ধযুক্ত হবে যদি তার ডায়রিয়া হয় । ঘনঘন মলত্যাগ শিশুকে বিরক্ত করবে এবং অস্থিরতার কারণে সে কাঁদতেও পারে । যে সব বাচ্চাদের দাঁত বেরুচ্ছে তাদেরও পেট খারাপ হতে পারে । তবে, ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণই ডায়রিয়ার প্রধান কারণ ।
শিশুদের মধ্যে আলগা গতির কারণগুলি
সদ্যজাত এবং ছোট শিশুদের ডায়রিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে এবং চিকিৎসা শুরু করার আগে কারণটা জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।
- দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা প্রায়শই রোটাভাইরাসে আক্রান্ত হয়, যেটা ডায়রিয়ার কারণ হয় ।
- দুধ, ডিম অথবা চীনাবাদাম থেকে অ্যালার্জিও পেট খারাপের কারণ হতে পারে, তাই আপনার সন্তানের এগুলিতে অ্যালার্জি আছে কিনা তা খোঁজাটাই সবার আগে উচিত ।
- যে কোন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক্স পেটেরর ভিতর ভালো ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে এবং এটা ডায়রিয়া ডেকে আনতে পারে ।
- যদি আশেপাশের জিনিসপত্র অপরিষ্কার থাকে এবং শিশু হামাগুড়ি দেয় অথবা কোন খেলনা বা অন্য জিনিস মুখে দেয়, এতে তার পেট খারাপ হতে পারে ।
শিশুর পেট খারাপের সেরা ঘরোয়া প্রতিকার
শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ততটা শক্তিশালী নয়, তাই তাদের ডায়রিয়া বা পেট খারাপের মতো পেটের রোগের প্রবণতা বেশি থাকে । ওটিসি ওষুধের ব্যবহারের পরিবর্তে ঘরোয়া প্রতিকার করাই সব থেকে ভালো উপায় । সৌভাগ্যক্রমে, শিশুদের ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য অনেক কার্যকর প্রাকৃতিক প্রতিকার আছে । এই অবস্থা যদি ৪৮ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে মারাত্মক ফলাফল এড়িয়ে যেতে সবসময় কোন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।
১) ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস)
একটি দুই মাস বয়সী শিশুর পেট খারাপের চিকিৎসার জন্য এটি একটি বহুকাল ধরে চলে আসা ঘরোয়া প্রতিকার । একটি ওআরএস কোন ওষুধের দোকান থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে, নাহলে বাড়িতেই তৈরি করা যেতে পারে । এক লিটার পরিস্রুত জল ভালো করে ফোটাতে হবে এবং সেটা ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য রাখতে হবে । এরপর ৬ চা-চামচ চিনি ও হাফ চা-চামচ লবণ দিয়ে ততক্ষণ মেশাতে হবে, যতক্ষণ না সেগুলি সম্পূর্ণ মিশে যায় । শিশুর শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া জল ও লবণ ও তরলের চাহিদা পূরণ করতে শিশুকে একটা সময়ের অন্তর নিয়মিত ওআরএস দিন । যদি আপনি বাড়িতে তৈরি করতে না পারেন, কাছের কোন ওষুধের দোকান থেকে কিনে নিন এবং খাওয়ানো শুরু করুন । ভাতের জলও শরীরের হ্রাসপ্রাপ্ত জল ও তরলের চাহিদা পূরণের দুর্দান্ত উপায় ।
২) কলা
পেট খারাপের কারণে শিশু অনেকটা পটাশিয়াম হারিয়ে ফেলে এবং এগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরী । কলাতে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন এ ও বি৬ থাকে । এটা শক্তির একটি বিস্ময়কর উৎস হিসাবে প্রমাণিত, কারণ পেট খারাপ শরীরকে দুর্বল করে দেয় এবং সৌভাগ্যক্রমে, বাচ্চারা কলার স্বাদ পছন্দও করে । এটি সারা বছরই পাওয়া যায় এবং বেশিরভাগ পরিবারে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অপরিহার্য খাবার ।
৩) আদা
পাচনতন্ত্রের জন্য আদা উপকারী এবং ডায়রিয়ার একটি কার্যকর চিকিৎসা । এক চা-চামচ আদা, একটু দারুচিনি গুঁড়ো, সামান্য একটু জিরে গুঁড়ো এবং এক চা-চামচ মধু মেশান । দিনে তিন বার ওই মিশ্রণ আপনার শিশুকে খাওয়ান । আপনি শিশুকে দেওয়ার আগে একটূ জায়ফলও দিতে পারেন এতে ।
৪) মুড়ি
এক বাটি মুড়ি এক গ্লাস জলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন । শিশুর পেট খারাপ দ্রুত নিরাময় করতে মুড়ি ছেঁকে নিয়ে সেই জল আপনার শিশুকে দিনে দুবার করে খাওয়ান । পালিশবিহীন সাদা চালে প্রচুর পরিমাণে শ্বেতসার বা শাঁস থাকে এবং খুব সহজে হজম হয়ে যায় । ডায়রিয়া থেকে উপশম পেতে এটিকে জলে সিদ্ধ করে, ছেঁকে আপনার শিশুকে খাওয়াতে পারেন । সদ্যজাত শিশুর ডায়রিয়ার এটি একটি কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার, প্রধানত, ভারতবর্ষে, যেখানে মুড়ি খুব সহজে পাওয়া যায় ।
৫) আপেল
আপেল হল প্যেক্টিনে ভরপুর, যা আপনার শিশুর মলকে শক্ত করতে সাহায্য করে । একটি আপেল ভালো করে ধুয়ে, জলে সিদ্ধ করে ভালো করে পিষে নিতে হবে, যাতে এটা নরম হয় এবং সহজে হজম করা যায় । এটি শুধু পেট খারাপকেই নিয়ন্ত্রণ করবে তা নয়, শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করবে ।
৬) লাল মুসুর ডালের স্যুপ
ডায়রিয়ায় ভুগলে আপনার শিশু কিছুই খেতে চাইবে না । যাইহোক, তাকে তার শরীরে শক্তির পরিমাণ বজায় রাখতে হবে, এই ক্ষেত্রে লাল মুসুর ডাল সাহায্য করতে পারে । এই ‘সুপারফুড’ প্রোটিন ও শক্তিতে ঠাসা, যার কারণে এটি স্বাস্থ্যকর ও সহজপাচ্য । এক কাপ লাল মুসুর ডাল জলে ফোটাতে হবে এবং সেটা ঠাণ্ডা হতে দিতে হবে । কিছুক্ষণ পর মুসুর ডাল থিতিয়ে পড়বে । সেখান থেকে জল আলাদা করে সেটা আপনার শিশুকে খাওয়ান । স্বাদ বাড়াতে সামান্য একটু লবণ দিন ।
৭) মাখন-তোলা দুধ
বাড়িতে তৈরি মাখন-তোলা দুধ জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য খুবই কার্যকর । এটি পাচনতন্ত্রের কাজকে দ্রুত মসৃণ করে এবং এটি সুস্বাদুও । লবন ও গোলমরিচ দিয়ে আপনার শিশুকে খেতে দিন । এটিকে ৮ মাসের থেকে বেশি বয়সের শিশুদের জন্য সুপারিশ করা হয় ।
৮) ডাবের জল
বিভিন্ন স্বাস্থকর উপকারিতা ছাড়াও, ডাবের জল আপনার শিশুকে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি দিতে একটি চমৎকার পানীয় । এটি যে শুধুমাত্র সুস্বাদু তাই নয়, এটি শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল ফিরে পেতেও সাহায্য করে । আপনার বাচ্চাকে দিনে অন্তত দুই থেকে তিনবার ডাবের জল দেওয়ার সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে ।
৯) দই
বাড়িতে তৈরি তাজা দই ও ইয়োগার্ট শিশুর পাচনতন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়াকে ফিরে পাওয়ার জন্য খুব উপকারী । যখন আপনার শিশুর ডায়রিয়া হয়, এটিকে সবচেয়ে অন্ত্রের জন্য উপকারী খাবার বলে ধরা হয় । বাড়িতে তৈরি লস্যি এবং মাখন-তোলা দুধেও (চিনি ছাড়া) প্রোবায়োটিক্স থাকে, তাই শিশুকে দেওয়ার আগে কখনো দু’বার ভাববেন না ।
১০) গাজরের রস
যখন আপনার শিশুর পেট খারাপ হয়, তখন তার হারিয়ে যাওয়া শক্তি ফিরে পাওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ । এই সময়ে গাজর শক্তির খুব ভালো উৎস । গাজরের রস অথবা পিউরি দিনে দু’বার পরিবেশন করা যেতে পারে । যদি আপনার শিশুর বয়স ১ বছরের উপরে হয়, তাহলে গাজরের রস তার জন্য ভালো ।
১১) স্বেতসার বা স্টার্চ-যুক্ত জিনিসপত্র
আপনি যদি আপনার ছোট্টটিকে অল্প-কঠিন / কঠিন খাবার দেওয়া শুরু করে থাকেন, তাহলে আপনি আলু এবং চালের সিরিয়ালের মতো স্টার্চযুক্ত খাবার নির্বাচন করতে পারেন । আলুতে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ বা স্বেতসার আছে, যা পেট খারাপ থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে সাহায্য করে । একটি আলু সিদ্ধ করুন, সেটিকে বেটে মসৃণ করতে হবে এবং এক চিমটি লবন দিতে হবে । গ্যাসের সমস্যা যাতে না হয়, তার জন্য ভাজা জিরে গুঁড়োও এতে দেওয়া যেতে পারে । এই আলু মাখা দিনে একবার করে দেওয়া যাবে ।
১২) লেবু
প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই লেবু খুঁজে পাওয়া যায় এবং এটি শিশুদের পেট খারাপের খুব ভালো একটি ঘরোয়া প্রতিকার । এটি প্রদাহ বা যন্ত্রণারোধী ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে ভরপুর, যার কারণে এটি নির্ভরযোগ্য এবং সহজলোভ্য প্রতিকার । দিনে চার থেকে পাঁচবার এক চামচ করে লেবুর রস ডায়রিয়া এবং অন্যান্য পেটের সমস্যার উপশম করতে পারে । আপনার শিশু পেটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে এবং তার শরীরের পিএইচ ব্যাল্যান্স পুনরায় সঠিক হয়ে যাবে ।
১৩) পুদিনা বা মিন্ট
মিন্ট পাতায়, যা পুদিনা নামেও পরিচিত, প্রচুর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে । সেগুলি পাচন পক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের পেট খারাপের উপশমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে পরামর্শ দেওয়া হয় । এক গুচ্ছ পুদিনা পাতা থেকে এক চামত পুদিনার রস পেতে পারেন । তাতে এক চা-চামচ মধু ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রসও যোগ করুন । আপনার শিশুকে দেওয়ার আগে মিশ্রণটিকে ভালো করে ঘুলিয়ে নিন । আপনার শিশুকে এই রস আপনি দিনে দুই থেকে তিনবার দিতে পারেন । এটিকে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবেন না ।
১৪) জায়ফল বা নাটমেগ
আপনার শিশুর পেট খারাপ বারবার ফিরে আসা আটকাতে এই শক্তিশালী ঘরোয়া প্রতিকার খুব পরিচিত । এটি ভারতে জায়ফল নামে পরিচিত । আপনি জায়ফল গুঁড়ো এবং জল মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করতে পারেন এবং আপনার শিশুকে দিতে পারেন ।
১৫) অ্যারারূট গুঁড়ো
অ্যারারুট মূলত স্বেতসার বা স্টার্চের গুঁড়োর একটি রূপ এবং এটি বাচ্চাদের পেট খারাপের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য একটি ভালো পরিপূরক । এটির অ্যালার্জি-মুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে, এটি আপনার ছোট্ট শিশুটির পেটের সমস্যার উপশমের সহায়ক । এটি শরীরের হারিয়ে যাওয়া জল ফিরিয়ে আনতেও চমৎকার কাজ করে । জল বা দইয়ের সঙ্গে অ্যারারুট গুঁড়ো মিশিয়ে একটি মসৃণ মন্ড বা গোলা তৈরি করুণ এবং আপনার শিশুকে খাওয়ান ।
যদি আপনার শিশু ডায়রিয়া হওয়ার কারণে কিছু খেতে না চায়, তাকে জোর করে না খাওয়ানোই ভালো । বেশ দীর্ঘ সময় পরপর তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন, যাতে তার ক্ষিদে পায় এবং খাবারকে অস্বীকার না করে । এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ঘরোয়া প্রতিকার প্রয়োগ করার আগে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত । আপনি আপনার শিশুর খাবারের তালিকায় তরল পদার্থ বাড়িয়ে দিতে পারেন । যদি পেট খারাপের পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গও লক্ষ্য করা যায় এবং ঘরোয়া প্রতিকার কোন কাজ না করে, তাহলে অবিলম্বে কোন শিশুবিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন ।