গর্ভাবস্থায় কম মাত্রায় অ্যামনিওটিক তরল (অলিগোহাইড্রামনিওস)

গর্ভাবস্থায় কম মাত্রায় অ্যামনিওটিক তরল (অলিগোহাইড্রামনিওস)

In this Article

অ্যামনিওটিক তরল হল জলের ন্যায় একটি তরল যা গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে সহায়তা করে।এটি এমন কিছু গুরুতর ক্রিয়া সম্পাদন করে যা আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠার সময় আপনার শিশুকে সুরক্ষিত রাখা এবং তার যথাযথ বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আসুন এখন আমরা অ্যামনিওটিক তরলের ব্যাপারে আরও কিছু এবং গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে এই তরলটি কমে যাওয়ার পিছনে থাকা কারণগুলির সন্ধান করি।

অ্যামনিওটিক তরল কি?

আপনার অভ্যন্তরে আপনার শিশুটি অ্যামনিওটিক স্যাক নামক একটি তরল পূর্ণ থলির মধ্যে বেড়ে ওঠে, আর এই অ্যামনিওটিক থলিটি অ্যামনিওটিক তরলে পূর্ণ থাকে। অ্যামনিওটিক তরল আপনার শিশুকে সব ধরণের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে নিরাপদে রাখে।আপনি যদি আপনার পেটে কোনও আঘাত পেয়ে থাকেন তবে তার থেকেও আপনার গর্ভস্থ শিশুকে এই তরলটি রক্ষা করে।এটি গর্ভের অভ্যন্তরের তাপমাত্রাকে স্থির রাখে এবং শিশুর পেশী, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, ফুসফুস এবং পাচন তন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আপনার শিশুটি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া শুরু করার কারণে সে অ্যামনিওটিক তরলটি গিলে ফেলা শুরু করবে এবং পরবর্তীতে সেটিকে প্রস্রাব হিসেবে ত্যাগ করবে।এইভাবে একটি শিশু তার নিজের চারপাশে অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণকে বজায় রাখে।

অলিগোহাইড্রামনিওস কি?

অলিগোহাইড্রামনিওস হল এমন একটি অবস্থা যেখানে অ্যামনিওটিক থলির ভিতরে অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ অত্যন্ত কমে যায়।চিকিৎসকরা আপনার অভ্যন্তরস্থ অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ পরিমাপ করতে পারেন অ্যামনিওটিক তরল সূচক মূল্যায়নের দ্বারা অথবা ডীপ পকেট পরিমাপ পদ্ধতির মাধ্যমে।যদি কোনও গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থার 32 তম থেকে 36 তম সপ্তাহের মধ্যে এই তরলটির পরিমাণ 500 মিলিটারের থেকেও কম থাকে তবে সেক্ষেত্রে অলিগোহাইড্রামনিওস সন্দেহ করা হয়।

অলিগোহাইড্রামনিওস নির্ণীত হয় যখনঃ

  • অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ 500 মিলিলিটারের কম হয়
  • পকেটের সর্বোচ্চ লম্ব উচ্চতা 2 সেন্টিমিটারেরও কম হয়
  • অ্যামনিওটিক তরল সূচকটি 5 সেন্টিমিটারের কম হলে।

অলিগোহাইড্রামনিওস হওয়া কতটা সাধারণ?

অলিগোহাইড্রামনিওসে ভুগে থাকা মহিলার শতকরা হার হল 8% এর কাছাকাছি এবং এটি গর্ভাবস্থার যেকোনও সময় হতে পারে, যদিও এটি গর্ভাবস্থার সর্বশেষ ত্রৈমাসিকে হওয়াটা সবচেয়ে সাধারণ একটি ব্যাপার।আপনি যদি আপনার প্রসবের নির্ধারিত তারিখ থেকে 2 সপ্তাহের মধ্যে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার দেহে অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা থাকে।গর্ভদশার 41 সপ্তাহ অতিক্রম করা গর্ভবতী মহিলাদের 12% এর মধ্যে অলিগোহাইড্রামনিওসের কারণে হয়ে থাকা নানা জটিলতা দেখা গেছে।

শিশুর বিকাশে অ্যামনিওটিক তরল কি ভূমিকা পালন করে?

নিম্নরূপ বেশ কয়েকটি কার্যকারিতা অ্যামনিওটিক তরলের রয়েছেঃ

  • শিশু যখন অ্যামনিওটিক তরলের মধ্যে বাধাহীন ভাবে নড়াচড়া করে, এটি তার অস্থি এবং পেশীর বিকাশে সহায়তা করে।
  • শিশু যখন অ্যামনিওটিক তরলটিতে প্রশ্বাস নেয় ও নিশ্বাস ছাড়ে, এটি তার ফুসফুসের বিকাশে সাহায্য করে।
  • শিশু যখন এই তরলটিকে গিলে ফেলা শুরু করে এবং প্রবর্তীতে প্রস্রাবের মাধ্যমে সেটি ত্যাগ করে, এটি তার পাচন তন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে।
  • অ্যামনিওটিক তরল আম্বিলিকাল কর্ড বা নাড়িকে সংকোচন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে, যার পরিণামস্বরূপ শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য মায়ের দেহ থেকে শিশুর দেহে পুষ্টি সরবরাহ একইভাবে বজায় থাকে।
  • অ্যামনিওটিক তরল আবার একটি পিচ্ছিলকারক পদার্থ হিসেবেও কাজ করে এবং হাতের আঙ্গুল এবং পায়ের আঙ্গুলের মত একসাথে বেড়ে ওঠা দেহের দুর্বল অংশগুলির বিকাশে সহায়তা করে।

গর্ভাবস্থাকালে দেহে কতটা অ্যামনিওটিক তরল থাকা স্বাভাবিক?

গর্ভাবস্থার 36 তম সপ্তাহ পর্যন্ত অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ সমানে বাড়তে থাকে এবং এর মধ্যে যেকোনও সময়ে এটির পরিমাপ 800-1000 মিলিটারের মধ্যে থাকলে তা স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।গর্ভদশার 36 তম সপ্তাহ পরে জন্মদানের প্রস্তুতির জন্য অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ কমে যেতে শুরু করে।গর্ভদশার 40 তম সপ্তাহের বা পূর্ণ মেয়াদের মধ্যে অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ কমে গিয়ে 600 মিলিলিটার মত হয়ে যায়, আর এটিও কিন্তু একেবারে স্বাভাবিক।

নিম্ন মাত্রার অ্যামনিওটিক তরলের সাধারণ লক্ষণগুলি

আপনার নিয়মিত চেক-আপের সময়, আপনার ডাক্তারবাবু আপনার পেটের উপর একটি নিবিড় নিরীক্ষণ বজায় রাখবেন।যদি আপনার পেটটি যেভাবে বাড়া উচিত সেভাবে না বাড়ে, তখন আপনার ডাক্তারবাবু আপনার গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য হয়ত আপনাকে একটি স্ক্যান করানোর কথা বলবেন।এখন, এটিই হল এর প্রথম লক্ষণ, এর আরও অন্যান্য লক্ষণগুলি হলঃ

রক্তচাপের উত্থান পতন

  • কম ওজনের বা আকৃতিতে ছোট শিশুর জন্ম হওয়া
  • যোনি থেকে অবিরত তরল লিক করা
  • মা এবং শিশু উভয়েই পর্যাপ্ত ওজন লাভ না করা
  • শিশুর বৃদ্ধি দীর্ঘায়িত হওয়া।

নিম্ন মাত্রার অ্যামনিওটিক তরলের কারণগুলি

গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যাওয়া হল একটি অত্যন্ত সাধারণ ঘটমান বিষয়।এর কারণগুলি নীচের যেকোনও একটি হতে পারেঃ

জল ভেঙ্গে যাওয়াঃ যদি আপনার অ্যামনিওটিক থলিটি ছিন্ন হয়ে যায় এবং তরল প্রবাহিত হয়, তখন এটিকে বলা হয় জল ভেঙ্গে যাওয়া।এটি সাধারণত হয়ে থাকে প্রসবের আশেপাশে এবং প্রসবের সময়।আপনি যদি প্রসবকালীন সময়ের থেকে বেশ দূরে না থেকে থাকেন, তবে আপনার ডাক্তারবাবু তখন আপনাকে হয়ত অ্যান্টোবায়োটিকগুলি দিতে পারেন, আপনার প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকার সময় আপনার গর্ভস্থ শিশু এবং আপনাকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য।আপনি যদি গর্ভাবস্থার 38 তম সপ্তাহ পার করে থাকেন, তবে আপনার অবস্থার উপর ভিত্তি করে ডাক্তারবাবু হয়ত আবার শ্রমে প্রবৃত্ত করার পরামর্শটি দেবেন।

  • স্বাস্থ্য বিপত্তিঃ আপনার শিশুর যদি কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তখন অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন হয়ত কমে যেতে পারে।বিশেষ করে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে করা স্ক্যানে যদি শিশুর কিডনি, হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যা অথবা ক্রমোজোমীয় অস্বাভাবিকতা ধরা পরে সেক্ষেত্রে এই তরল কমে যায়।আপনার বাচ্চা যদি খুব কম প্রস্রাব করে তবে স্ক্যানে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।আপনার ডাক্তারবাবু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যামনিওসেন্টেসিস নামে আরও একটি পরীক্ষা করানোর পরামর্শও দিতে পারেন।
  • অমরার সহিত সমস্যাঃ আপনার যদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লুপাস বা প্রিক্ল্যাম্পসিয়া হয়ে থাকে তবে আপনার প্লাসেন্টা আপনার শিশুর পর্যাপ্ত রক্ত ​​এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হতে পারে।এই ক্ষেত্রে,শিশুর মধ্যে অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন হ্রাস পেতে পারে এবং আপনাকে হয়ত কঠোর নিরীক্ষণের মধ্যে রাখা হতে পারে।
  • ওষুধঃ গর্ভাবস্থায় বেশ কিছু ওষুধ অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত কারণ যেহেতু সেগুলি অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ হয়ে ওঠে।বিশেষত উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ, আইবুপ্রোফেনের মত প্রদাহ বিরোধী ওষুধগুলি গর্ভাবস্থায় সেবনের জন্য নির্ধারিত হয় না।
  • অভিন্ন যমজঃ যদি অভিন্ন যমজ একটি প্ল্যাসেন্টা ভাগ করে, তবে সেক্ষেত্রে কখনও কখনও অ্যামনিয়োটিক তরল কমে যাওয়ার মত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।এই ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত রক্তযুক্ত শিশুটি অ্যামনিয়োটিক তরলটি উপলব্ধি করবে তবে অন্যটি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবে না।
  • যদি আপনার ডাক্তারবাবু উপরোক্ত সকল কারণগুলিকেই এক্ষেত্রে বাতিল করেন বা অস্বীকার করেন, তবে সেক্ষজেত্রে এ ব্যাপারে চিন্তার কিছু নেই।অনেক সময় দেখা গেছে যে গরমের সময় ডিহাইড্রেশনের কারণে অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যায়।সুতরাং পর্যাপ্ত জল পান এবং যথেষ্ট বিশ্রাম নিলে তা এ ব্যাপারে সহায়ক হবে।

অলিগোহাইড্রামনিওস নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলি

অলিগোহাইড্রামনিওস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিম্নোলিখিত পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করা যেতে পারেঃ

  • আল্ট্রাসাউন্ডঃ অলিগোহাইড্রামনিওস নির্ধারণের প্রথম এবং সর্বোত্তম রোগ নির্ণয় পদ্ধতিটি হল একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান পরিচালনা করা।আল্ট্রাসাউন্ড করার সময় আপনার জরায়ুর চারটি বিভিন্ন অংশে অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন পরিমাপ করা হয় আর তারপর এই চারটি মান একত্র করে অ্যামনিওটিক তরল সূচক বা AFI নিয়ন্ত্রণ করা হয়।তাছাড়াও শিশুর বৃক্ক এবং মূত্রথলি পরিমাপ করা হয় সেখানে কোনও ব্যতিক্রম বা অসঙ্গতি আছে কিনা তা দেখার জন্য।আল্ট্রাসাউন্ড পদ্ধতিটির দ্বারা রোগ নির্ণয়ের মধ্যে আবার শিশুর বৃদ্ধি মূল্যায়ণটিও অন্তর্ভূক্ত যেটি করা হয় শিশুর পেটের পরিধি, মাথার পরিধি এবং ফিমারের দৈর্ঘ্য পরিমাপের দ্বারা।
  • অ্যামনিওটিক তরল সূচক(AFI): AFI পরিমাপ করা হয় আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে এবং এটি একটি ব্যাপক প্রচলিত এবং নিরাপদ পরীক্ষা।এই পরীক্ষাটি আপনার জরায়ুতে অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবুকে সহায়তা করে।
  • স্টেরাইল বা জীবাণুমুক্ত স্পেকুলাম পরীক্ষাঃ এই পরীক্ষাটি ডাক্তারবাবুরা পরিচালনা করে থাকেন অ্যামনিওটিক থলির আবরণীর চলনের পরিসর পরীক্ষা করার জন্য,যা ঝিল্লী ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে এবং পরিণতিতে যা অ্যামনিওটিক তরল লিক করার কারণ হয়ে ওঠে।
  • সর্বাধিক উলম্ব পকেটঃ এই পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে জরায়ুর পুরু অংশে অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন পরীক্ষা করার জন্য যার মধ্যে ভ্রূণের অংশ এবং আম্বেলিক্যাল কর্ড বা নাড়ি অন্তর্ভূক্ত থাকে না।এই পরীক্ষাটি পরিচালনা করতে আরও একবার আল্ট্রাসাউন্ড পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়।
  • রক্ত পরীক্ষাঃ বিভিন্ন রকম রক্ত পরীক্ষা যেমন মায়ের সিরাম স্ক্রীনিং করালে তা নিম্ন অ্যামনিওটিক তরল শনাক্তকরণে সহায়তা করতে পারে।এছাড়াও আপনার শিশুর মধ্যে ডাউন সিন্ড্রোমের মত কোনও জন্মগত সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষা করতেও আপনার ডাক্তারবাবুকে এটি সহায়তা করে।
  • অ্যামনিওটিক রিঙ্কল বা কুঞ্চনঃ আপনি যদি আপনার গর্ভে অভিন্ন যমজ সন্তান বহন করেন তবে আপনার মধ্যে হয়ত অ্যামনিওটিক রিঙ্কল হয়ে থাকতে পারে যেটি যমজ সন্তানের মধ্যবর্তী আবরণীটি ভাঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে হয়।অ্যামনিওটিক রেখাটিকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করার দ্বারা, ডাক্তারবাবু নির্ধারণ করতে পারবেন যে উভয় শিশুই পর্যাপ্ত অ্যামনিওটিক তরল পাচ্ছে কিনা।
  • উপরের যে কোনও মূল্যায়ন যদি অলিগোহাইড্রামনিওসকে নির্দেশ করে, তখন আপনার গর্ভাবস্থা এবং প্রসব পরিচালনা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের একটি দলের প্রয়োজন পড়বে।

অলিগোহাইড্রামনিওসের ঝুঁকির কারণগুলি

কিছু মহিলা আবার অন্যদের তুলনায় অলিগোহাইড্রামনিওসের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ

  • গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ
  • ডায়াবেটিস বা মধুমেহ
  • অমরায় সমস্যা
  • লিউপাস
  • স্থূলতা

গর্ভাবস্থায় আপনি যদি এই সকল সমস্যাগুলির কোনও একটিরও মুখোমুখি হন, তবে গর্ভাবস্থার এই জটিলতাগুলির জন্য নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়াটাই হল বিচক্ষণতার কাজ।

অ্যামনিওটিক তরলের নিম্ন মাত্রা আপনার শিশুর উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে?

যদি গর্ভাবস্থার প্রথম এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে দেহে অ্যামনিওটিক তরলের নিম্ন মাত্রা নির্ণীত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তার সাথে অসংখ্য এবং গুরুতর সমস্যা জড়িত থাকে।আর এই একই জিনিস যদি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ধরা পড়ে, তবে পরিস্থিতিটিকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে রাখা যেতে পারে কারণ এই পর্যায়ে জটিলতাগুলি মোকাবিলা করার জন্য চিকিৎসকেরা আরও ভালভাবে প্রস্তুত থাকেন।নিম্ন অ্যামনিওটিক তরলের সাথে সংযুক্ত সমস্যাগুলি নিম্নরূপঃ

  • আপনার সন্তান গুরুতর জন্মগত অক্ষমতার সাথে জন্মগ্রহণ করতে পারে যেমন কোনও আভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অঙ্গাণুর অনুপস্থিতি অথবা ডিসপ্ল্যাসিয়া বা ক্লাবফুট বা বিকৃত পায়ের মত হাড়ের বিকৃতি বা বিকলাঙ্গতার সহিত জন্মগ্রহণ।
  • এর ফলে আবার মৃত সন্তানের জন্ম অথবা গর্ভাবস্থার 20 সপ্তাহ পর জরায়ুতেই শিশুর মৃত্যু ঘটে থাকে।কিছু শিশু আবার জন্ম পরমুহূর্তেও মারা যায়।
  • অ্যামনিওটিক তরলের নিম্ন মাত্রার সাথে যুক্ত অপর আরেকটি জটিলতা হল গর্ভাবস্থার 20 তম সপ্তাহ পর গর্ভপাত ঘটে যাওয়ার মত দুঃখজনক ঘটনা।
  • গর্ভদশার 37 তম সপ্তাহের আগেই কম ওজন এবং অপূর্ণবিকশিত অঙ্গ-প্রঙ্গের সহিত শিশুর অকাল জন্ম।
  • যদি গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অলিগোহাইড্রামনিওস ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে কিছু শিশু আবার সীমিত বৃদ্ধি, শ্রমের সময় সঙ্কুচিত আম্বেলিক্যাল কর্ড বা নাড়ির সহিত এবং অস্ত্রপচারের মাধ্যমে প্রসব ক্রিয়া সম্পাদনের মাধ্যমে জন্ম গ্রহণ করতে পারে।

নিম্ন মাত্রায় অ্যামনিওটিক তরলের জটিলতাগুলি

অলিগোহাইড্রামনিওসের প্রভাবে শিশুর উপর দেখা দেওয়া কিছু গুরুতর জটিলতাগুলি নিম্নে তালিকাবদ্ধ করা হলঃ

  • ভ্রূণের কম্প্রেশন সিন্ড্রোম
  • অ্যামনিওটিক ব্যান্ড সিন্ড্রোম
  • পালমোনারি হাইপোপ্লাজিয়া
  • ভ্রূণের গুরুতর সংক্রমণ

এই সকল জটিলতাগুলি আপনার গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং তা শিশুর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

অলিগোহাইড্রামনিওসের জন্য চিকিৎসাগুলি

যদি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অলিগোহাইড্রামনিওস ধরা পড়ে, তবে সেটি সামাল দেওয়ার জন্য চিকিৎসকরা আরও ভালভাবে প্রস্তুত থাকেন।তাছাড়াও আবার অবস্থাটি যদি হালকা হয়, তবে সেক্ষেত্রে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এর কোনও চিকিৎসা করার প্রয়োজন পড়ে না।অলিগোহাইড্রামনিওস পরিচালনা করার জন্য ডাক্তারবাবু আপনাকে কেবল নিরীক্ষণের মধ্যে রাখাই পছন্দ করবেন।কিন্তু অলিগোহাইড্রামনিওসটি যদি আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম কিম্বা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে আপনার জরায়ুর মধ্যে নিম্ন অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা মোকাবিলা করতে নিম্নোলিখিত চিকিৎসাগুলি অনুসরণ করা হতে পারেঃ

  • অ্যামনিওইনফিউশনঃ এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে, ডাক্তারবাবু ঘরের তাপমাত্রায় আপনার অ্যামনিওটিক থলির মধ্যে একটি ইন্ট্রাইউটেরাইন ক্যাথেটারের মাধ্যমে সোডিয়াম ক্লোরাইড প্রবিষ্ট করান।
  • ভ্যাসিকো-অ্যামনিওটিক শান্টঃ আপনার গর্ভস্থ শিশুটি প্রস্রাব না করতে পারার কারণে যদি অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যায়, তবে ডাক্তারবাবু ভ্যাসিকো-অ্যামনিওটিক শান্টের সাহায্যে আপনার শিশুর প্রস্রাব নিঃসরণ করানোর চেষ্টা করবেন।যদিও এই পদ্ধতিটি আপনার জরায়ুর নিম্ন অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রার যত্ন নেবে ঠিকই কিন্তু এটি আপনার গর্ভস্থ শিশুর বৃক্ক এবং ফুসফুসের কার্যকর কার্যকারিতাকে নিশ্চিত করে না।
  • ফ্লুইড ইঞ্জেকশনঃ অ্যামনিওসেন্টেসিসের সাহায্যে ফ্লুইড ইঞ্জেকশন দেওয়ার মাধ্যমে অলিগোহাইড্রামনিওসের চিকিৎসা করার এটি একটি অস্থায়ী পদ্ধতি।
  • মায়ের হাইড্রেশন বা জলযোজনঃ এখানে, অ্যামনিওটিক তরলের আয়তন বাড়াবার জন্য ডাক্তারবাবু আপনাকে প্রচুর জল পান করার পরামর্শ দেবেন এবং আপনাকে IV বা ইন্ট্রাভেনাস(শিরার মাধ্যমে দেহে সরাসরি তরল বা ওষুধ প্রেরণ) ও প্রচুর তরল পান করতে বলবেন।যদি ডিহাইড্রেশনের কারণে অলিগোহাইড্রামনিওস হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।
  • বেড রেস্টঃ আপনার যদি হালকা মানের বা অল্প মাত্রায় অলিগোহাইড্রামনিওস হয়ে থাকে, তবে আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখবেন এবং আপনাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টের পরামর্শ দেবেন।যথোপযুক্ত হাইড্রেশন এবং সম্পূর্ণ বেড রেস্ট আন্তঃভাস্কুলার স্থানগুলি বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে ফলে তা অ্যামনিয়োটিক তরলটির জন্য আরও বাশি জায়গা তৈরী করে।
  • গর্ভাবস্থার অবসানঃ সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হতে পারে যেটি তা হল গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে গুরুতর অলিগোহাইড্রামনিওসের কারণে গর্ভাবস্থার চিকিৎসার পরিসমাপ্তি।কিন্তু এটি আপনার এবং আপনার অনাগত সন্তানের জন্য ভাল কারণ এইক্ষেত্রে শিশুটি জন্মালে হয়ত গুরুতর এবং একাধিক ত্রুটির সাথে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
  • অলিগোহাইড্রামনিওসের চিকিৎসার জন্য আপনার ডাক্তারবাবু সাধারণ মাতৃ ভ্রূণের ওষুধের একজন বিশেষজ্ঞকে এর সাথে জড়িত রাখবেন।হাইড্রপস ফোয়েটালিস
  • এবং জন্মগত বিকলাঙ্গতাগুলির মত গুরুতর জটিলতাগুলি যেগুলি নিম্ন মাত্রার অ্যামনিওটিক তরলের কারণে আপনার শিশুর মধ্যে হয়ে থাকে তা মোকাবিলা করার জন্য এটি করা হয়ে থাকে।

কীভাবে আপনি অলিগোহাইড্রামনিওস প্রতিরোধ করতে পারেন?

  • অলিগোহাইড্রামনিওসকে সম্পূর্ণ রূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় এবং কিছু সতকর্তা এবং সাবধানতা অবলম্বনের দ্বারা গর্ভাবস্থায় অ্যামনিওটিক তরলের মাত্রা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করা যেতে পারে।
  • প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন এবং নিজেকে হাইড্রেট রাখুন।অনেক ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশনের থেকেও অলিগোহাইড্রামনিওস হয়ে থাকে।
  • স্বাস্থ্যকর আহার করুন এবং আপনার ডাক্তারবাবুর কথা শুনুন।প্রয়োজনে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
  • আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে কথা না বলে কোনও ওষুধ সেবন করবেন না এমনকি হার্বাল পরিপূরক অথবা ভিটামিনগুলিও নয়।
  • নিজেকে অতিমাত্রায় পরিশ্রম না করিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করুন।তবে পর্যায়ক্রমে হাঁটা অথবা প্রসব পূর্ব হালকা যোগ-ব্যায়ামগুলি গর্ভাবস্থার পক্ষে উপকারী।
  • ধূমপান বন্ধ করুন, এটি সরাসরি আপনার শিশুর ফুসফুসে প্রভাব ফেলে।
  • ব্যর্থতা ছাড়া আপনার প্রসব পূর্ববর্তী নিয়মিত চেক-আপগুলি অব্যহত রাখুন।শুধুমাত্র নিয়মিত চেক-আপ এবং আপনার ডাক্তারবাবুর সহযোগিতা গর্ভাবস্থায় আপনার হয়ে থাকা যেকোনও সমস্যা অথবা অস্বাভাবিকতাগুলিকে নির্ধারণ করে চিকিৎসার দ্বারা তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে সহায়ক হবে।

অলিগোহাইড্রামনিওস হালকা অথবা গুরুতর হতে পারে।উভয় ক্ষেত্রেই,
আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে চান।কোনওক্ষেত্রে সামাণ্যতম সন্দেহ জাগলেই আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন এবং তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করুন।সাবধান হন এবং সতর্ক দৃষ্টি বজায় রাখার সাথে আপনার গর্ভাবস্থাকে লালন করুন।