গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়া

গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়া

একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য একজন হবু মায়ের সকল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া নিশ্চিত করতে তার স্বাস্থ্যকর খাবারগুলি খাওয়া আবশ্যক।তার ডায়েটের মধ্যে ফল, শাকসবজি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যগুলি অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।আজ আমরা একটি সবজির বিষয়ে কথা বলব যেটি ভীষণ স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত এবং একজন গর্ভবতী মহিলার জন্যও এটি অত্যন্ত উপকারি হয়ে উঠতে পারে।এই সবজিটি হল সজনে।গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি সম্পর্কে জানতে পড়ুন।

সজনে জিনিসটি কি?

সজনে বা ড্রামস্টিক হল দীর্ঘ, সরু এবং মাংসল বীজের শুঁটি সমন্বিত এক ধরণের ডাটা বিশেষ যা মোরিঙ্গা ওলিফেরা বা সজনে গাছে বেড়ে ওঠে মোরিঙ্গা ওলিফেরা বা ড্রামস্টিক বা সজনে গাছটি উত্তরপশ্চিম ভারতের স্থানীয়।ক্রান্তীয় অঞ্চলে এর ব্যাপকভাবে চাষ হয় যেখানে এর বীজ, পাতাগুলি এবং কচি বীজের শুঁটি সবজি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।সজনে কেবল সবজি হিসাবেই ব্যবহৃত হয় না, এটি যে পরিমাণে পুষ্টি সরবরাহ করে তার কারণে এটি আবার জল পরিশোধন করতে, হাত ধোয়ার জন্য এবং ভেষজ ওষুধেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে

গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়া কি নিরাপদ?

গর্ভদশায় সজনে খাওয়া একেবারে নিরাপদ।তবে খাওয়ার আগে এগুলিকে অবশ্যই খুব ভালভাবে ধুয়ে নিন এর গায়ে লেগে থাকা ধূলোময়লা এবং জীবাণুগুলি থেকে রেহাই পেতে।যেকোনও পুষ্টিকর খাবারের মতই এটিও আপনার সিমীত পরিমাণে সংযমের সাথে খাওয়া উচিত।সজনের পাতা,বীজের শুঁটি এবং বীজ সবকিছুই পুষ্টিতে পরিপূর্ণ এবং ভক্ষণযোগ্য।

সজনের পুষ্টি মূল্য

সজনের মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে যেগুলি একজন গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্য এবং তার সাথে তার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারি।কেবল 100 গ্রাম সজনে পাতার মধ্যেই রয়েছে উচ্চ পরিমাণে খাদ্যমধ্যস্থ তন্তু, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন।

এছাড়াও এগুলিতে রয়েছে ফোলেটের দৈনিক প্রস্তাবিত খাদ্যমধ্যস্থ পরিমাণ বা রেকমেন্ডেড ডায়াটরি অ্যালাউয়েন্স(RDA), ক্যালসিয়াম (RDA এর 19%), আয়ণ বা লোহা (RDA এর 31%) এবং অল্প পরিমাণে অপরিহার্য খনিজগুলি যেমন ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং জিঙ্ক বা দস্তা আবার সজনে পাতাতেও রয়েছে ভিটামিন A (RDA এর 47%), ভিটামিন  B1 বা থায়ামিন (RDA এর 22%), ভিটামিন B2 বা রিবোফ্ল্যাভিন (RDA এর 55%), ভিটামিন B6 (RDA এর 92%), এবং ভিটামিন B3, B5 C

লম্বা, কোমল এবং শাঁসাল বীজের শুঁটিযা গাছটিকে তার নামকরণ করেছে, মূলত খাওয়া হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ায়।এগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে সেদ্ধ করে নরম করা হয় এবং তরকারির সাথে যোগ করা হয়।এ্রর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন C এবং পটাশিয়াম। ডায়াটরি ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজেরও একটি দুর্দান্ত উৎস হল সজনে।

সজনের দানাগুলিকে বের করে নেওয়া যেতে পারে এবং সেগুলিকে ভেজে নিয়ে বাদাম অথবা আবার এমনকি মটরশুঁটির মতও খাওয়া যেতে পারে।এগুলির মধ্যে থাকে ভিটামিন C এবং একটা ভাল পরিমাণে ভিটামিন B এবং বিভিন্ন খনিজ।

গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি

সজনেগুলি বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানে পরিপূর্ণ।একজন হবু মা এবং তার গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, অন্তঃসত্ত্বাকালে সজনে খাওয়ার বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে।গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়া কীভাবে আপনাকে উপকার করতে পারে তা এখানে দেওয়া হলঃ

1.প্রাতঃকালীন অসুস্থতা কমায়

গর্ভাবস্থায় সজনে খেলে তা প্রাতঃকালীন অসুস্থতার লক্ষণগুলি কমাতে সাহায্য করতে পারে।এই সময় প্রাতঃকালীন অসুস্থতার কারণে হয়ে থাকা অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে,বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরা কমাতেও এটি ব্যাপকভাবে সাহায্য করতে পারে।নিয়মিত ভাবে সজনে খেলে তা একজন গর্ভবতী মহিলাকে সতেজ বোধ করাতে এবং সক্রিয় রাখতে পারে।

2.জন্মগত ত্রুটিগুলি রোধে সহায়তা করতে পারে

সজনে পাতায় রয়েছে ফোলেট, যা শিশুর নিউরাল টিউব গঠণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন যা শিশুর ব্রেন এবং মেরুদণ্ড গঠণ করে।গর্ভাবস্থায় ফোলেটের অভাবের কারণে স্পাইনা বিফিডার মত নিউরাল টিউবের ত্রুটি দেখা দিতে পারে যা শিশুর গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরী করতে পারে। তবে সজনের মত ফোলেটের পরিমাণ বেশি এমন খাবার গ্রহণের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় জন্মগত ত্রুটিগুলি রোধে সহায়তা করা যেতে পারে

3.রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করতে পারে

রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সজনে ভীষণ কার্যকর।প্রতিদিন সজনে খেলে তা আপনার রক্ত শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং গর্ভাবস্থাকালীন ডায়াবেটিসের মত জটিলতাগুলি রোধ করতে সহায়তা করতে পারে।

4.হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে

সজনেতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় ক্যালসিয়াম, আয়রণ বা লোহা এবং বিভিন্ন খনিজ যা শক্তিশালী হাড় গঠণে এবং হাড়ের ভাল স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

5.রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে

অ্যানিমিয়া, বিশেষ করে আয়রণের ঘাটতি জনিত অ্যানিমিয়া, গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকা একটি সাধারণ সমস্যা।গর্ভাবস্থায় আয়রণের ঘাটতি দেখা দেওয়াটা সাধারণ ব্যাপার, তবে অন্তঃসত্ত্বাকালে সজনে খেলে তা রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে পারে আর এইভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা রোধে সাহায্য করতে পারে।

6. ইনফেকশন বা সংক্রমণ রোধ করতে পারে

সজনের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যাবলী আর এটি সংক্রমণ রোধ করতে এবং কোনও গর্ভবতী মহিলার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে।

7.কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে স্বস্তি আনতে পারে

বেশিরভাগ মহিলারাই তাদের গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিনন্যের অভিযোগ করে থাকেন। আপনারও যদি সেই সমস্যা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনার ডায়েটের মধ্যে সজনে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব আপনাকে দেওয়া হচ্ছে।সজনের মধ্যে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে খাদ্য মধ্যস্থ তন্তু বা ডায়াটরি ফাইবার যা মলকে নরম করে তুলতে সহায়তা করে আর তার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

8.পেট ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে

সজনের মধ্যে কিছু ঔষধি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের পেট ব্যথা বা পেটের সমস্যা নিরাময় বা প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে।আমাশয়, কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদির মত রোগের লক্ষণগুলি লাঘব করতে সজনে পাতার সাথে কচি নরম নারকেলের জল দেওয়া হয়ে থাকে।

9.প্রসবে সহায়তা করতে পারে

সজনে জরায়ুর সঙ্কোচনগুলির উন্নতি ঘটাতে এবং শ্রমের বেদনা হ্রাস করতে পারে আর এইরূপে এটি পরোক্ষভাবে সন্তান প্রসবে সহায়তা করে এবং প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জটিলতাগুলি হ্রাস করে।

10.শ্বাকষ্ট কমায়

এক বাটি গরম সজনে পাতার স্যুপ নাক বন্ধ হওয়া পরিষ্কার করতে এবং গলা ব্যথা ও সর্দি কমাতে সাহায্য করতে পারে।সজনে ব্রঙ্কাইটিস এবং হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার জন্য প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

সজনে খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি

যদিও সজনে বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানে পরিপূর্ণ এবং একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য ভীষণভাবে উপকারি, তবুও সজনে গাছের এমন কিছু অংশ আছে যেগুলি থেকে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।তাছাড়াও অতিমাত্রায় সেবনের ফলে তা আবার দেহের মধ্যে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

  • সজনে গাছের ছাল এবং মূলের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে যা গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটাতে পারে।সুতরাং সেগুলি কোনও সম্ভাবনাতেই খাওয়া উচিত নয়।এর মূলে এমন এক রাসায়নিক থাকে যা থেকে আবার প্যারালাইসিসও হতে পারে।
  • গর্ভবতী মহিলা এবং বাচ্চাকে স্তন পান করানো মায়েদের পক্ষে সজনে ফুলটিও খাওয়া নিরাপদ হবে না কারণ সেগুলিতেও বিষাক্ত রাসায়নিক থাকতে পারে।

অতএব, গর্ভাবস্থায় বা অন্য যেকোনও সময় খাওয়ার আগে সমস্ত সবজিগুলিকে অবশ্যই বেশ ভালভাবে সকলের ধুয়ে নেওয়া উচিত।

আপনার গর্ভাবস্থার ডায়েটে কীভাবে সজনের সংযোজন ঘটাবেন

আপনি যদি আপনার গর্ভাবস্থার ডায়েটে সজনে অন্তর্ভূক্ত করতে চান, এখানে তার কিছু উপায় উল্লেখ করা হল, আপনি চেষ্টা করতে পারেন।তবে আপনার ডায়েটের মধ্যে সেটি প্রবেশ করানোর আগে আপনার ডাক্তারবাবু বা ডায়াটেশিয়ানের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে নেওয়াটা নিশ্চিত করুন

  • পাতাগুলি দিয়ে আপনি স্যুপ বানাতে পারেন।
  • সজনে পাতা এবং দানাগুলিকে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রাখতে পারেন যা পরবর্তীতে আপনার স্যালাডের উপর ছিঁটিয়ে দিতে বা ভাতের সাথে মেখে নিতে পারেন।
  • সজনে বীজের শুঁটিগুলি সাধারণত খুব ভালমত সেদ্ধ করে নেওয়া হয় এবং সাম্বার বা অন্য কোনও সবজির সাথে মেশানো হয়।
  • আপনি সজনে পাতাগুলিকে ঠিক পালং শাকের মত করে রান্না করে একটা সুস্বাদু সাইড ডিশ বানাতে পারেন।

সঠিক সজনে কেনার টিপস

সজনে কেনার সময় আপনার যেগুলি লক্ষ্য করা উচিত তা হলঃ

  • বীজের শুঁটি নরম, উজ্জ্বল সবুজ এবং সামাণ্য তাকে বাঁকানো যেতে পারে এমন হওয়া উচিত।যদি সেগুলি শক্ত হয়, তার উপরে গুঁটি বিশেষ হয়ে থাকে এবং রঙটা ফিকে হয়ে যায়, তার মানে হল সজনেগুলি তাজা নয়।
  • এর পাতাগুলি তাজা এবং ঘন সবুজ হওয়া উচিত।
  • সজনে ডাটার এমন গোছা তুলে নিন যার গাটি হবে মসৃণ।খসখসে গা হওয়া মানে হল সেগুলো বুড়ো হয়ে গেছে এবং সেগুলো খেতেও তেঁতো হতে পারে।

কীভাবে সজনে স্টোর করবেন

সজনেগুলোকে ক্লিঙ ফিল্মে ভালভাবে মুড়িয়ে ফ্রিজের মধ্যে রাখা উচিত।কেনার 2-3 দিনের মধ্যেই সেগুলি খেয়ে নেওয়া সবচেয়ে ভাল।ব্যবহারের আগে পাতাগুলিকে গাছের ডাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভালমত ধুয়ে নেওয়া উচিত।সেগুলোকে একটা এয়ারটাইট বাক্সতে করে ফ্রিজের মধ্যে 1-2 দিন রাখা যেতে পারে।

গর্ভাবস্থায় সজনে খাওয়ার উপকারিতা বহুবিধ।প্রতিদিন সংযমের সাথে পরিমিত পরিমাণে সজনে খেলে তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ভাল হতে পারে।তবে গর্ভাবস্থায় আপনার ডায়েটে সজনে অন্তর্ভূক্ত করার আগে একবার তা আপনার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং পুষ্টিবিদকে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে তাঁদের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ আপনাকে দেওয়া হচ্ছে।