শিশুর দাঁত গজানোর সময়ের কার্যকরী প্রতিকার

শিশুর দাঁত গজানোর সময়ের কার্যকরী প্রতিকার

শিশুর দাঁত গজানো চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘Odotiasis’ শব্দেও পরিচিত । শিশুদের সাধারণত ৬ষ্ঠ থেকে ২৪তম মাসের মধ্যে দাঁত গজানো শুরু হয় । এই সময়, দাঁত মাড়ির ফুটো থেকে বেরোতে শুরু করে । প্রথম দুইটি দাঁত উপরের দিকে কেন্দ্রে এবং নীচের কেন্দ্রে অবস্থিত হয় । দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া একটি বাহ্যিক প্যাটার্ন অনুসরণ করে পেষক দাঁতগুলি দিয়ে শেষ হয় ।

দাঁত গজানোর প্যাটার্নগুলি –

  • নিচের কেন্দ্রে কর্তন দাঁত
  • উপরের কেন্দ্রে কর্তন দাঁত
  • উপরের পার্শ্ববর্তী কর্তন দাঁত
  • নিচের পার্শ্ববর্তী কর্তন দাঁত
  • পেষক দাঁতগুলি
  • শ্বাদন্ত (কুকুরের মতো দাঁত)
  • দ্বিতীয় পেষক দাঁতগুলি

নীচের এবং উপরের কেন্দ্রীয় এবং পার্শ্ববর্তী কর্তন দাঁতগুলি ২টি করে সেট হিসাবে গজায় এবং পেষক দাঁতগুলি, শ্বাদন্ত এবং দ্বিতীয় পেষক দাঁতগুলি ৪টি করে সেট হিসাবে গজায় ।

কেন দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া একটি শিশুকে যন্ত্রণা দেয়?

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া বেদনাদায়ক এবং শিশুর অস্বস্তির কারণ হয় । কারণ দাঁত মাড়ির টিস্যুর নিচে থেকে বেরোতে শুরু করে, যার কারণে জায়গাটি লাল হয়ে যায়, ফুলে যায় ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে । কিছু দাঁত, যেমন পেষক দাঁত, আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়, কারণ এটি অন্য অংশের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল এবং অনেকটা জায়গা নেয় ।

শিশুদের দাঁত গজানোর চিহ্ন এবং লক্ষণ

দাঁত গজানোর কোন বিশেষ লক্ষণ বা চিহ্ন নেই । এই উপসর্গগুলি কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী হতে পারে অথবা কয়েক মাস ধরে বজায় থাকতে পারে, যদি অনেক দাঁত একই সময়ে গজিয়ে উঠতে শুরু করে । এই কারণে মাড়িতে যন্ত্রণা শুরু হয়, কারণ এটি এখনও সংবেদনশীল । নিম্নলিখিতগুলি দাঁত গজানোর লক্ষণ হতে পারে –

শিশুদের দাঁত গজানোর চিহ্ন এবং লক্ষণ

১) প্রচুর লালা বের হওয়া

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া লালা বেরনোকে বৃদ্ধি করে, যার অর্থ শিশুর জামাকাপড় ঘনঘন ভিজে যাবে এবং আদ্র থাকবে ।

২) কাশি

অনবরত লালা বের হওয়ার কারণে শিশুর সর্দি এবং কাশি হতে পারে । তবে, ঠান্ডা এবং ফ্লু-এর অন্য কোনো লক্ষণ না থাকলে এটি উদ্বেগের কারণ নয় ।

৩) দাঁত বেরনোর সময়ের র‍্যাস

অনবরত লালা বের হওয়ার কারণে শিশুর মুখের চারপাশে চুলকানি, লালাভাব এবং র‍্যাস হতে পারে ।

৪) কামড়ে ধরা

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া গজাতে থাকা দাঁতের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা মাড়িতে খোঁচা মারে এবং শিশুর অস্বস্তি সৃষ্টি করে ।

৫) কান্না

ব্যথা এবং অস্বস্তি প্রতিটি শিশুর আলাদা হয় । কয়েকজন আরামদায়কভাবেই দাঁত পেতে পারে, অন্যদের মাড়ি এলাকার যন্ত্রণার কারণে অনেক কষ্ট ভোগ করে ।

৬) খিটখিটেভাব

শিশুদের দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া চলাকালীন ছটফটে এবং উত্তেজিত হয়ে যায়, কারণ দাঁত মাড়ির পৃষ্ঠের মধ্যে ঠেলা দেয় ।

৭) খাবার খেতে অস্বীকার করা

বদমেজাজি, অস্বস্তিপূর্ণ শিশুকে খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে শান্ত রাখা যায়, কারণ তাদের মুখে কিছু থাকবে ।

৮) রাতে জেগে ওঠা

শিশু দাঁত গজানোর অস্বস্তির কারণে রাতে বারবার ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে ।

৯) কান টান এবং গাল ঠেলা

যে শিশুদের দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাদের কান টানা অথবা থুতনি বা গাল ঘষার ঝোঁক থাকে ।

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট অস্বস্তির তীব্রতা বিভিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয় এবং যদি আপনি মনে করেন যে একটি পেশাদার সহায়তার প্রয়োজন হয়, তবে আপনি একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে পারেন ।

শিশুদের দাঁত গজানোর ব্যাথা কমানোর উপায়

যখন আপনি নিশ্চিত হয়েছেন যে দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আপনি শিশুর যন্ত্রণা এবং অস্বস্তি প্রশমিত করার জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন, যেমন –

১) প্রাকৃতিক প্রতিকার

কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার রয়েছে, যা শিশুকে ব্যথা থেকে নিস্তার দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে । আপনি শিশুদের দাঁত গজানোর জন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন ।

২) লোয়ার ইনফ্ল্যামেশন

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া জীবাণুর আক্রমণের কারণ হতে পারে, যা মাড়ির স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে, ফলে যন্ত্রণা হ্রাস করলে শিশুর ব্যাথা হ্রাস পাবে ।

৩) পালিও- টাইপ খাবার

পালিও- টাইপ খাবার দেওয়া খুব উপকারী । এতে তাজা ফল এবং সবজি, পেস্টুরাইজড মাংস এবং নারকেল মাখনের মতো স্বাস্থ্যকর ফ্যাটগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।

৪) বিশ্রাম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য

ফর্মুলা এবং বুকের দুধের সাথে শিশুর বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করা উচিত ।

৫) উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার

রক্ত চাপ কমিয়ে চাপের মাত্রা কমানো যায় । উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার শিশুকে খাওয়ানোর দ্বারা করা যেতে পারে ।

৬) ঠান্ডা পদার্থ

ঠান্ডা এবং চাপ দাঁত গজানোর ব্যাথার সঙ্গে লড়াই করার জন্য এবং প্রতিকার হিসাবে দুটি চমৎকার এবং পুরনো কৌশল । অল্প বরফ বা কাপড়ের মত ঠান্ডা পদার্থ যন্ত্রণার এলাকা এবং চাপকে কমিয়ে মাড়ির শান্ত করতে সহায়তা করে ।

৭) হোমিওপ্যাথি

শিশুদের দাঁত গজানোর যন্ত্রণার জন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধ লালচেভাব, ফোলাভাব, এবং ব্যথা থেকে শিশুকে উপশম দেওয়ার এবং শিশুকে শান্ত রাখা একটি নিরাপদ উপায় ।

৮) পেশাদারের সহায়তা

দাঁত গজানোর সমস্যাগুলি খুব মারাত্মক হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ নেওয়া উচিত । দাঁত গজানোর পর্যায়ের উপর নির্ভর করে, নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া হয় ।

৯) ওষুধের দোকান থেকে আনা ওষুধ

বাড়ির প্রতিকারগুলি যদি বেশি সাহায্য না করে, তবে আপনি শিশুকে দোকান থেকে আনানো ওষুধগুলি দিতে পারেন । সমস্যা তীব্রতর হলে কোনও ঔষধ দেওয়ার আগে আপনার শিশুটিকে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে মূল্যায়ন করানো উচিত ।

১০) চিত্তবিনোদন বা মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া

আপনি যদি কিছু ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে আপনার শিশুকে বিভ্রান্ত করতে পারেন, তারা কিছু সময়ের জন্য ব্যথা ভুলে যাবে ।

শিশুদের দাঁত গজানোর ব্যাথার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

কিভাবে দাঁত গজানোর সময় একটি শিশুকে শান্ত করবেন? দাঁত গজানোর কারণে হওয়া ব্যথা প্রশমিত করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে এবং আপনি যদি ওষুধের পথে যেতে না চান, তবে ঘরোয়া প্রতিকারগুলিও ব্যবহার করা যেতে পারে ।

শিশুদের দাঁত গজানোর ব্যাথার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

১) ফ্রিজে ঠাণ্ডা করা কাপড়

আপনি একটি ফ্রীজারে ঠাণ্ডা করার পরে একটি কাপড়ের টুকরো শিশুকে চুষতে বলুন ।

২) ফল

বেদনাদায়ক ব্যথাতে সাহায্য করার জন্য শিশুকে ঠান্ডা চামচে হিমায়িত ফল বা সবজিগুলি চিবানোর জন্য দিন ।

৩) প্রাকৃতিক কঠিন কাঠের খেলনা

কাঠের অমসৃণ অবস্থা শিশুর বেদনাকে প্রশমিত করার জন্য সুখকর হবে ।

৪) পরিষ্কার আঙুল

আপনি যন্ত্রণাযুক্ত মাড়িতে একটি পরিষ্কার আঙুল ঘষতে পারেন, এটি সাময়িকভাবে ব্যথা নিশ্চিহ্ন করতে পারে । এটি সাধারণত একটি প্রতিকার, যা খুব একটা বেশি কাজ করে না ।

৫) বিস্কুট

দাঁত গজানোর বিস্কুট বাজারে সহজলভ্য । এগুলির অমিষ্টতা সেই সব শিশুদের জন্য খুব ভালো, যাদের যন্ত্রণা আছে ।

৬) ঠান্ডা খাওয়ানোর বোতল

যদি আপনি একটি খাওয়ানোর বোতলকে উল্টো করে রেখে ফ্রিজে ঠাণ্ডা করেন, বোতলের বৃন্তের কাছাকাছি যে বরফ জমে, তা একটু বেশি কঠিন হয়ে ওঠে । আপনার শিশু যদি ছটফট করতে শুরু করে, তাকে এটি চিবানোর জন্য দিতে পারেন ।

৭) কলা

কলা উত্তেজিত শিশুদের জন্য খুব ভালো, কারণ তারা নরম হয় এবং শিশুর গলাতে আটকে যায় না ।

৮) গাজর

গাজর একটি অন্য উদ্ভিজ্জ, যা শিশুকে দেওয়া যেতে পারে, কারণ এটি চিবানোর জন্য যথেষ্ট কঠিন এবং যখন শিশুর দাঁত গজানো শুরু হয়, তখন আপনার শিশুকে সাহায্য করবে । সর্বদা নিশ্চিত করুন যে, শিশুকে গাজর দেওয়ার সময় আপনি যেন তার চারপাশে থাকেন, কারণ সে গাজর গিলে ফেলতে পারে এবং শিশুর গলায় আটকে যেতে পারে ।

৯) আপেল সস

ঠান্ডা আপেল সস সান্ত্বনাদায়ক এবং একটি সন্তানের দাঁত গজানোর সময় তাকে শান্ত করার একটি দুর্দান্ত উপায় ।

১০) ভ্যানিলা নির্যাস

আপনার শিশুর মাড়িতে একটু ভ্যানিলা নির্যাস ঘষলে সহায়ক হতে পারে । ভ্যানিলার স্বাদ শিশু উপভোগ করবে ।

১১) আদা

আদা দাঁত গজানোর ব্যথার নিস্পত্তির জন্য একটি দুর্দান্ত সমাধান হিসাবে কাজ করে, কারণ শিশু এই শক্ত বাইরের আবরণে কামড় দিতে পারে এবং নিজেকে শান্ত করতে পারে ।

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া কত দীর্ঘ বজায় থাকে?

দাঁত গজানোর প্রক্রিয়া প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয় । কিছু শিশুদের মধ্যে, প্রথম দাঁত ৬ মাসের মধ্যে অথবা শিশুর প্রথম জন্মদিন পর্যন্ত দেরী হতে পারে । পুরো প্রক্রিয়া প্রায় ২ বছর সময় নিতে পারে ।

দাঁত গজানোর সময়সীমা (আনুমানিক) –

দাঁত গজানোর সময়সীমা

  • কেন্দ্রীয় কর্তন দন্ত: ৬-১২ মাস বয়সে
  • পার্শ্বীয় কর্তন দন্ত: ৯-১২ মাস বয়সে
  • শ্বাদন্ত: ১৬-২৩ মাস বয়সে
  • প্রথম পেষক দন্ত: ১৩-১৯ মাস বয়সে
  • দ্বিতীয় পেষক দন্ত: ২২-২৪ মাস বয়সে ।

প্রতিটি দাঁতের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া প্রায় এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়, প্রথম দাঁত গজানো শুরু হয় এবং শেষ দাঁত গজানোর কয়েকদিন পরেও চলতে থাকে ।

শিশু এবং তার অভিভাবক, উভয়ের জন্য দাঁত গজানোর সময় একটি কঠিন পর্যায়, কিন্তু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক পর্যায়ও । সন্তানের প্রয়োজনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং পর্যায়ক্রমিক ও প্রয়োজনীয় হিসাবে এই পর্যায়কে গ্রহণ করা আপনার যে কোনও উদ্বেগ শান্ত করতে দীর্ঘ পথ যেতে পারে ।