In this Article
আয়ুর্বেদের প্রাচীন চিকিৎসা বিদ্যালয় তুলসীর ব্যাপক গুণাবলীগুলি দীর্ঘকাল ধরে পূর্ণ সমর্থন করে আসছে।এটি ভারতীয় ঘরোয়া প্রতিকারগুলির মধ্যে একটা সক্রিয় ও কার্যকর উপাদান, যা বিভিন্ন অবস্থা থেকে মুক্তি আনে।তবে শুদ্ধ তুলসী এবং গর্ভাবস্থার বিষয়ে পরিচালিত গবেষণার কিন্তু আবার কিছু বিরোধী ফলাফলও রয়েছে।গর্ভাবস্থায় তুলসী সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয় কিনা জানার জন্য পড়ুন।
তুলসী (শুদ্ধ বেসিল) কি?
তুলসী বা শুদ্ধ বেসিল হল এক ধরণের ভেষজ গুল্ম যা মিন্ট বা মেন্থল অথবা পুদিনা গোষ্ঠীর একটা অংশ।একটা আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধের সাথে এর পাতাগুলি সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে, যা হালকা মিষ্টি এবং একটা ঝাঁঝালো স্বাদের হয়।স্যালাড এবং স্যুপের মধ্যে এর স্বাদটিকে যুক্ত করার জন্য একটা টপিং হিসেবে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় তো এটা ব্যাপক হারে পাওয়া যায়ই, তবে জনপ্রিয়তার কারণে এটা আবার বিশ্বের অন্যান্য অংশেও পাওয়া যায়। তাছাড়াও এটা ভারতীয় পরিবারগুলিতে বহু কাল যাবৎ ব্যবহার হয়ে আসছে বিভিন্ন অসুখের ক্ষেত্রে একটা ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে।
গর্ভাবস্থায় তুলসী খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি
গর্ভাবস্থায় তুলসী খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলির কয়েকটি নীচে দেওয়া হলঃ
- ভিটামন A সমৃদ্ধ
তুলসীর মধ্যে থাকা ভিটামিন A ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এটি আপনার শিশুর হৃদ্পিণ্ড, ফুসফুস, চোখ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে।
- ভ্রূণের হাড় গঠণে সাহায্য করে
শুদ্ধ বেসিল বা তুলসীতে ভাল পরিমাণে ম্যাঙ্গানীজ রয়েছে যা আপনার শিশুর মধ্যে তার হাড় এবং তরুনাস্থিগুলি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।ম্যাঙ্গানীজ আবার নিজে খুব ভাল একটা অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসকে হ্রাস করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে কোষের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ফ্রি রেডিক্যালস বা মুক্ত মূলকগুলি দেহের কোষগুলির ক্ষতি করে।
- রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করে
ভ্রূণের বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য গর্ভবতী মহিলার দেহে অতিরিক্ত রক্তের প্রয়োজন হয়।তুলসীর মধ্যে থাকা ফোলেট গর্ভাবস্থাকালীন প্রয়োজনীয়তা পূরণে আপনার দেহে রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।আবার শিশুর মধ্যে জন্মগত ত্রুটিগুলি রোধ করার ক্ষেত্রেও ফোলেট উপকারী বলে জানা যায়।
- রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে
তুলসী আয়রনের একটা দুর্দান্ত উৎস যা গর্ভবতী মহিলাদের শক্তিশালী ও সক্রিয় রাখার জন্য জরুরি।আয়রন আপনার রক্তে লোহিত রক্ত কণিকার (RBC) সংখ্যা এবং হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে, আর এটি গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে অ্যানিমিয়া দেখা দেওয়ার ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধিকারী
তুলসী বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজের একটা ভাল উৎস যা গর্ভবতী মহিলাদের অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করে।এর মধ্যে একটা ভাল পরিমাণে ভিটামিন C, ভিটামিন E, নিয়াসিন, রাইবোফ্লাভিন ইত্যাদি থাকে এবং তার সাথে আবার রয়েছে পটাশিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানীজ, কপার, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়ামের মত খনিজগুলি, যেগুলি আপনাকে এবং আপনার অনাগত শিশুকে সংক্রমণগুলির প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারে।এটা আবার আপনার শিশুর যথাযথ সঠিক বিকাশেও সাহায্য করবে।
- ব্যথা–বেদনা এবং যন্ত্রণাগুলি হ্রাস করে
তুলসী মধ্যস্থ এর প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্যটি গর্ভাবস্থায় দেখা দেওয়া যেকোনও সাধারণ ব্যথা–বেদনা, যন্ত্রণাগুলি থেকে স্বস্তি আনার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।
এই সকল উপকারিতাগুলি ছাড়াও তুলসী আবার মানসিক চাপ হ্রাস করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।তুলসী সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বরের এবং ফুসফুসকে শক্তিশালী করে তোলারও একটা ভাল প্রতিকার।
গর্ভাবস্থায় তুলসী খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি
অনেক উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও তুলসীর কিন্তু কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে, যদি সেটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয়ে থাকে।এখানে সেরকমই কিছু ঝুঁকির বিষয় আলোচনা করা হল যা তুলসী খাওয়া থেকে গর্ভাবস্থায় দেখা দিতে পারেঃ
- এটি হল একটি হাইপোগ্লাইসেমিক
হাইপোগ্লাইসেমিক উপাদানগুলি আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়। সুতরাং গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণে তুলসী গ্রহণ করলে তা মাথা ঘোরা, কাঁপুনি ওঠা এবং অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
- এটা জরায়ুর সঙ্কোচনের কারণ হয়ে উঠতে পারে
জরায়ুর সঙ্কোচনের কারণ হিসেবে তুলসী পরিচিত।আর এই কাণের জন্যই চিকিৎসকরা মহিলাদের গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানের সময় তুলসী সেবন করার পরামর্শ দেওয়ার বিরোধী হয়ে থাকেন।
- এর মধ্যে রক্ত তরলীকরণ প্রভাবটি রয়েছে
তুলসী রক্তকে ভীষণ ভাবে পাতলা করা এবং দীর্ঘ পর্যায়ে রক্ত ক্ষরণের কারণ হিসেবে পরিচিত।সুতরাং যেসকল গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে তাদের রক্ত কার্যকরভাবে জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী অসুখগুলি বিদ্যমান, তাদের তুলসী খাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
- এটা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে
তুলসীর মধ্যে ইউজেনল নামে একটি তেল থাকে, যা অতিরিক্ত পরিমাণে সেবন করলে তার ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি শরীরে দেখা দেয়।এটি হৃদ্স্পন্দনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, মুখ এবং গলাতে জ্বলন অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনার গভীর শ্বাস–প্রশ্বাসের অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। তদুপরি, এটি আবার মাথা ঘোরা, খিঁচুনি, প্রস্রাবের সময় রক্তপাতের মত সমস্যাগুলি দেখা দেওয়ার কারণ হতে পারে এবং চরম ক্ষেত্রে কোমায় আক্রান্ত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
আপনি কি তুলসী চা সেবন করতে পারেন?
গর্ভাবস্থায় তুলসী চা খাওয়ার বিষয়ে কিছু বিরোধী তথ্য পাওয়া গেলেও, এ ব্যাপারে পরিচালিত কিছু পরীক্ষা নির্দেশ করে যে এটি বদহজম, বমি এবং পিঠে ব্যথা রোধ করতে সহায়তা করে।তবে এটাও অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই উপকারিতাগুলির বিষয়ে কোনও ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়নি।আর এজন্যই চিকিৎসকরা গর্ভাবস্থায় তুলসী চা খাওয়ার পরামর্শ দেন না।
যাইহোক, তবে তুলসী চা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি দ্বারা করটিসোল হরমোনের উৎপাদন হ্রাস করে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ হ্রাস করতেও পরিচিত।
তুলসী সেবনের সময় যে সাবধানতাগুলি গ্রহণ করা প্রয়োজন
আপনি যদি গর্ভাবস্থায় পবিত্র তুলসী পাতার স্বাস্থ্য উপকারগুলি উপভোগ করতে এবং সেটিকে আপনার ডায়েটের একটা অংশ হিসাবে গড়ে তুলতে চান তবে আপনার এবং আপনার গর্ভস্থ শিশুর, উভয়েরই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আপনাকে নিম্নলিখিত সতর্কতাগুলি অবলম্বন করতে হবে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে এটি গ্রহণ করবেন না।যদিও তুলসীর মত অ্যাডাপ্টোজেন ভেষজগুলির জন্য কোনও প্রস্তাবিত ডোজ নেই, তবে ভেষজবিদরা এই ভেষজের পাচন কেবল 115 মিলিলিটার দিনে তিন বার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- টক্সোপ্লাজমোসিস এবং লিস্টারোসিসের মত খাদ্যজনিত সংক্রমণের কারণ হতে পারে এমন ব্যাকটিরিয়া বা পরজীবীগুলি পরিষ্কার করে দূর করার জন্য, সেবন করার আগে এই ভেষজের পাতাগুলি ভালভাবে ধুয়ে নিন।
- তুলসীকে আপনার গর্ভদশার একটা অংশ করে তোলার আগে সর্বদা আপনার ডাক্তারবাবুর মতামত নিয়ে চলুন।
তুলসীর অসংখ্য উপকারিতা আছে যা এটিকে গর্ভাবস্থার জন্য একটা চমৎকার ভেষজ পরিপূরক করে তুলেছে।তবে যেহেতু গর্ভবতী মহিলা এবং ভ্রূণের ওপর পড়া এর প্রভাবগুলির ব্যাপারে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা হয় নি, তাই অনেক ডাক্তারই গর্ভাবস্থায় মহিলাদের এই ভেষজটি অতিরিক্ত গ্রহণ করা এড়ানোর পরামর্শ দেন।যদি আপনি নিয়মিতভাবে এটি গ্রহণ করার কথা বিবেচনা করেন, তবে কোনওরূপ নেতিবাচক প্রভাব রোধ করার জন্য এটি আপনার এবং আপনার শিশুর ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা ভালভাবে জেনে বুঝে নিতে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে সর্বদা এই পছন্দের বিষয়টির ব্যাপারে আলোচনা করে নিন।