শক্ত খাবার খাওয়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন।আপনার বাচ্চাটি যখন শক্ত খাবারের দুনিয়ায় পা রাখতে চলেছে তখন স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে শুরু করা ভাল। শিশু–চিকিৎসকেরা নিরামিষ দিয়েই শুরু করতে বলেন। সঠিক সবজি চয়ন তদের ভাললাগা বাড়িয়ে তোলে এবং তাদের খাওয়ানো সন্তোষজনক হয়।
কিভাবে বাচ্চাদের জন্য সবজি মন্ড বা পিউরি বানাতে হয় ?
যদিও বাজারে বিভিন্ন শিশু খাদ্য(বেবি ফুড) পাওয়া যায় তবে সাস্হ্যকর হল আপনার শিশুর খাবার টাটকা সবজি দিয়ে বাড়িতে বানানো। শাক সবজিতে বিভিন্ন পুষ্টি পদার্থ আছে যা আপনার শিশুর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।তাই বাড়িতে তৈরী সবজি মন্ড বা পিউরি হল শাক সবজির দুনিয়ায় প্রবেশ করানোর সেরা রাস্তা।
আপনি স্টীম করতে, সেদ্ধ করতে অথবা সেঁকতে পারেন সবজি গুলোকে। নিচে কয়েকটি সবজির সেঁকার পদ্ধতি বলা হল।
- আপনি মিষ্টি আলু সেঁকতে পারেন 400 ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় 40 থেকে 45 মিনিট ধরে। আপনি অবশ্যই সেঁকার আগে আলুটিতে কতগুলো ছিদ্র করে নেবেন এবং ফয়েল ঢাকা দিয়ে সেঁকবেন।
- আপনি আলুটিকে সেঁকতে পারেন ওভেনটিকে 425 ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রেখে।বেকিং ট্রেতে দেবার আগে আলুটিকে ছিদ্র করে নেবেন।45 মিনিট ধরে বেক করুন,ঠান্ডা হবার পর খোসা ছাড়িয়ে নিন।
আপনি সবজি গুলিকে স্টীম দেবার জন্য ইডলি স্টীমার বা অন্য কোন স্টীমার ব্যবহার করতে পারেন।যদি আপনার স্টীমার না থাকে তাহলে আপনি সবজি গুলোকে সেদ্ধ করে নিতে পারেন।
এখন দেখা যাক কিভাবে আপনি আপনার ছোট্ট সোনাটার জন্য সব থেকে ভাল পাঁচটি পুষ্টিকর এবং রঙিন সবজি মন্ড বা পিউরি বানাবেন।
মন্ড বা পিউরি তৈরীর আগে আপনি চামচ ,বাটি গুলোকে গরমজলে ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিন এবং ব্যবহার করার আগে পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখুন।
1. কুমড়োর মন্ড বা পিউরি রন্ধন প্রণালী
কুমড়োতে প্রচুর পরিমান বিটা– ক্যারোটিন, প্রোটিন এবং ভিটামিন C থাকে।এইগুলি আপনার বাচ্চার শরীরের রোগ – প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। কুমড়ো মিষ্টি বলে বাচ্চারা খেতে ভালবাসে। আপনার শিশুর বয়স 6 মাস হলে আপনি তাকে এটি দিতে পারেন। কুমড়ো কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে যেহেতু এতে প্রচুর তন্তু(ফাইবার) থাকে। এতে ভাল পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে,কুমড়োর জীবাণুনাশক ক্ষমতা অন্ত্রের কৃমি নাশ করে।
উপকরন
- কুমড়ো – ½ কাপ ছোট টুকরো করে কাটা
- জল – পরিমান মত
পদ্ধতি
- জলের ধারা দিয়ে ভাল করে কুমড়োর টুকরো গুলোকে ধুয়ে নিন।
- খোসা ছাড়াবার যন্ত্র দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিন।
- বীজগুলো বার করে দিন
- কুমড়োটিকে ছোটো ছোটো সমান ঘনকাকৃতির করে কাটুন।
- কুমড়র টুকরো গুলোকে স্টীমারে রেখে 15 মিনিট ধরে স্টীম দিন বা যতক্ষণ না সেটি সেদ্ধ হচ্ছে।আপনি এটিকে এক কাপ জল দিয়ে সেদ্ধ করতে পারেন।
- সেদ্ধ কুমড়োটিকে ভাল করে চটকান এবং পরে ব্লেন্ডারের সাহায্যে মসৃন কাথ (পেষ্ট) বানান।
- গরম গরম পরিবেশন করুন।
2. আলুর মন্ড বা পিউরি রন্ধনপ্রনালী
আলুতে প্রচুর পরিমানে কার্বহাইড্রেট থাকে,এছাড়াও ভাল পরিমান ভিটামিন A এবং C থাকে।যদিও ভাল পরিমান পুষ্টিকর পদার্থ আছে তবুও আলু খেলে অনেক সময় বাচ্চাদের পেটে গ্যাস হয়।বাচ্চার বয়স 8 মাস হলেই তাকে আলু মাখা বা আলু মন্ড বা পিউরি দেওয়া ভাল।আলুতে বর্তমান ফসফরাস হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।
উপকরন
- আলু – 1 টি মাঝারি আকৃতির
- মাখন – 1 চা চামচ
- বুকের দুধ/কৌটোর দুধ/গরুর দুধ– 1 টেবিল চামচ
- হিং – এক চিমটে
- নুন – পরিমান মত
- মরিচ গুড়া – সামান্য
- জল – প্রয়োজন মত
পদ্ধতি
- জলের ধারা দিয়ে আলুটিকে ধুয়ে নিন
- আপনি নিচের যেকোন একটা প্রক্রিয়া করতে পারেন
অ) খোসা ছাড়াবার পর আপনি আলুটিকে ঘণকাকৃতির ছোটো ছোটো টুকরো করতে পারেন।
আ) খোসা সমেত আলুটিকে ঘণকাকৃতির টুকরো করে কাটতে পারেন।
- আলুর টুকরো গুলোকে প্যানে বসিয়ে এক কাপ জল দিয়ে সেদ্ধ করুন,আপনি প্রেসারে এক কাপ জল দিয়ে এটি করতে পারেন।
- আলু সেদ্ধ হয়ে যাবার পর যদি অতিরিক্ত জল থেকে যায় তা ফেলে দিন।
- খোসা ছাড়িয়ে নিন।(যদি আপনি খোসা সহ সেদ্ধ করে থাকেন।)
- আলুটি কে বড় বাটিতে নিন। এবার তাতে মাখন এবং হিং মেশান।
- ভাল করে চটকান
- এতে নিচের জিনিস গুলো মেশান
ক) বুকের দুধ বা কৌটার দুধ বা গরুর দুধ
খ) নুন
গ) মরিচ
- মন্ড বা পিউরি বানানোর জন্য এটিকে ভাল করে মেশান অথবা ব্লেন্ডারের বা মিক্সারের সাহায্যে ব্লেন্ড করুন।
3. মিষ্টি আলুর মন্ড বা পিউরি রন্ধনপ্রনালী
মিষ্টি আলুর পিউরি খুবই জনপ্রিয়।কারণ এটি নরম এবং খেতে মিষ্টি ও নন অ্যালার্জিক।এটি শিশুদের 6 মাস বা তার বেশী বয়সে দেওয়া যেতে পারে।প্রচুর তন্তু (ফাইবার) থাকার জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।এতে ভিটামিন A,C,E থাকে।এছাড়াও ক্যালসিয়াম ও আয়রণ ভাল পরিমানে আছে।এই পৌষ্টিক উপাদান গুলো ভাল দৃষ্টিশক্তি,সুন্দর ত্বক এবং পৌষ্টিকনালীকে সুস্থ রাখে।
উপকরন
- মিষ্টি আলু – 1 টি মাঝারি আকৃতির
- মাখন অথবা বাড়িতে তৈরী ঘি – 1 চা চামচ
- এলাচ গুঁড়ো – 1/8 চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী)
পদ্ধতি
- জলের ধারা দিয়ে মিষ্টি আলু টাকে ধুয়ে নিন।
- মিষ্টি আলুটিকে টুকরো করুন।
- প্রেসার কুকারে মিষ্টি আলুটিকে দিয়ে তিনটে সিটি দিয়ে নামিয়ে নিন। আপনি এটিকে সেদ্ধ বা স্টীম করতে পারেন বা সেঁকতে পারতেন।
- হাত দিয়ে খোস ছাড়িয়ে নিন।
- একটা বড় বাটিতে সেদ্ধ হওয়া আলুটি নিন।
- কাঁটার (কাঁটা চামচের) সাহায্যে ভালভাবে মেশান।আপনি ব্লেন্ডার বা মিক্সারের সাহায্যে এটিকে ব্লেন্ড করতে পারেন।
- ঘি গরম করুন এবং তাতে চটকানো মিষ্টি আলু এলাচ গুঁড়োর সাথে দিয়ে দিন।
- অল্প আঁচে দুই মিনিট ভাজুন।যখন ঘি এর সাথে ভালভাবে মিশে যাবে তখন আঁচ থেকে নামান।
- আপনি এর সাথে বুকের দুধ,কৌটোর দুধ বা গরুর দুধ মেশাতে পারেন
4. মটর শুটির মন্ড বা পিউরি রন্ধনপ্রণালী
সবুজ মটরশুটি ক্যালসিয়াম,আয়রন,প্রোটিন,ভিটামিন A এবং C তে ভরপুর।মটরশুটি আপনার শিশুর হাড় ও মাংস পেশীর গঠন করতে সাহায্য করে।এটি আপনি শুরু করতে পারেন যখন আপনার বাচ্চার বয়স 6 মাস বা তার বেশী হবে।মাঝারি মটরশুটি ভাল,এগুলো নরম ও মিষ্টি হয়।কৌটার মটরশুটি থেকে তাজা মটরশুটি অনেক ভাল।ভালভাবে সীল করে ফ্রিজে রাখা মটরশুটি ব্যবহার করতে পারেন।
উপকরন
- সবুজ মটরশুটি – একমুঠো
- জল– প্রয়োজন অনুযায়ী
পদ্ধতি
- যদি আপনি তাজা মটরশুটি নেন তাহলে খোসা ছাড়িয়ে বীজ গুলো নিন।
- জলে বীজ গুলো ধুয়ে নিন
- স্টীমারের সাহায্য স্টীম করুন যতক্ষণ না নরম হয়ে যায়। আপনি জল দিয়ে ফুটিয়ে নিতে পারেন সেটা সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত।
- ভাল করে মেশান আপনি ব্লেন্ডার ব্যবহার করে পেষ্ট বানিয়ে নিতে পারেন।
- আপনি মেস স্টেনার ব্যবহার করে সমস্ত খোসা বের করে নিতে পারেন
- এর সাথে জল,বুকের দুধ, কৌটোর দুধ বা গরুর দুধ মেশাতে পারেন মিশ্রণটির ঘণত্ব অনুযায়ী।
5. বিট গাজর আলুর মন্ড বা পিউরি তৈরীর রন্ধন প্রণালী
প্রচুর পরিমান আয়রন এবং ভিটামিন A আছে বিট এর মূলে।গাজরে আছে বিটা–ক্যারোটিন এবং ভিটামিন A।এইটি শিশুর দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। আলুতে কার্বহাইড্রেট প্রচুর পরিমানে থাকে।অনেক বাচ্চা বিটের মন্ড বা পিউরি পচ্ছন্দ করে না। সেক্ষেত্রে তাদের গাজর বিট ও আলুর মন্ড বা পিউরি খেতে দিতে পারেন। আপনি এই মিশ্রণটি আট মাস বা তার বেশী বয়সের শিশুদের দিতে পারবেন।
উপাদান
- গাজর– 1 টি মাঝারি আকারের
- বিট – ছোট বিটের ½ অংশ
- আলু – 1 টি মাঝারি আকৃতির
- জল – প্রয়োজন মত
পদ্ধতি
- সবজি গুলিকে জলের ধারা দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে।পিলার দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে।
- ছোট করে সমান ভাবে ঘণকাকৃতির কাটতে হবে।
- কাটা সবজি গুলো 15 মিনিট ধরে স্টীম করুন।আপনি প্রেসার কুকারে এক কাপ জল দিয়ে দুটো সিটি দিয়ে নামিয়ে নিন।
- সবজি রান্না হয়ে গেলে ব্লেন্ডারের সাহায্যে সেটিকে পেষ্ট বানান।
- মিশ্রণে জল, বুকের দুধ বা কৌটোর দুধ বা গরুর দুধ মিশিয়ে তার গাঢ়ত্ব ঠিক করুন।
যে ব্যাপার গুলো মাথায় রাখতে হয়
সবজি মন্ড হল দারুন পুষ্টিকর খাবার।আমরা এখানে আপনার বাচ্চার জন্য কতকগুলো সবজি মন্ডের রন্ধন প্রনালী নিয়ে আলোচনা করেছি,আপনি আপনার সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আপনার পছন্দ মত সবজি নিন যা আপনার শিশুটি ভালবাসে এবং তা দিয়ে তার প্রিয় সবজি বানান।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা আপনাকে মনে রাখতে হবে এই পুষ্টিকর সবজি মন্ড বানানোর আগে তা নিচে দেওয়া হল :
- বেশির ভাগ পুষ্টিকর পদার্থ ঠিকমত বজায় রাখার জন্য রাখার জন্য বিশেষজ্ঞ্ররা সুপারিশ করেন সবজি গুলিকে সেদ্ধ করার পরিবর্তে স্ট্রীম করার জন্য।
- তাজা এবং গরম গরম সবজি মন্ড পরিবেশন করার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।তৈরী করার 2 ঘন্টার মধ্যে আপনার শিশুকে এটা খাওয়ান।
- ভাল আলু বাছুন,অবশ্যই দেখে নেবেন যেন সেগুলোতে কোন খুঁত বা ফাটা না থাকে।যেগুলো অঙ্কুরিত হয়ে গেছে বা নরম দাগ আছে সে গুলো বাদ দেবেন।
- যদিও আপনি ব্লেন্ডার ব্যবহার করেন তবুও আপনি ম্যাসারের সাহায্যে স্টীমড সবজি গুলোকে চটকাতে পারেন।
- মন্ড গুলির গাঢ়ত্ব ঠিক রাখার জন্য আপনি এটিতে বুকের দুধ বা কৌটোর দুধ বা গরুর দুধ এমনকি গরম জল মেশাতে পারেন। দুধ মেশানোর পর এটাকে আর গরম করবেন না।
- যদি আপনার শিশুর কোনো উপাদানে এলার্জি থাকে তাহলে মন্ড বানানোর সময় সেটিকে বাদ দিন।
- বাচ্চাটিকে খাওয়ানোর জন্য আপনি অতি অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করে নিয়ে বাটি বা চামচ ব্যবহার করবেন।
- যদিও এটা আবশ্যিক নয় তবুও আপনি শক্ত খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে তিন দিনের সূত্র প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।
- এই শক্ত খাবার খাওয়ানো ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে যে আপনার বাচ্চার কোন সবজিতে এলার্জি আছে কিনা। আপনি নিচের নিয়মটি মানতে পারেন
-
- 1ম দিন – 1 টেবিল চামচ সারা দিনে একবার
- 2য় দিন – 2 টেবিল চামচ সারা দিনে দুইবার
- 3য় দিন – 3 টেবিল চামচ সারা দিনে দুইবার
1 টেবিল চামচ মোটামুটি 15 মি.লি। যাইহোক আপনি তিন দিনের পর থেকে 90 মি.লি পরিমান খাবার দিতে পারেন।
- আপনি যখন আপনার বাচ্চাকে নতুন খাবার দেবেন তার সহ্যশক্তির দিকে নজর রাখবেন।যদি কোনো রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন সঙ্গে সঙ্গেই নতুন খাবার দেওয়া বন্ধ করুন, এবং ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলুন।
আপনার সোনার জন্য স্বাস্থ্যকর,সম্পূর্ণ,সুস্বাদু খাবার বানানোর কাজটি খুব চালাকির সাথে করতে হলেও এটা দারুন আনন্দের।আপনি অতি–উৎসাহী হতে পারেন কিন্তু মনে রাখবেন আপনার বাচ্চাটি সহজে হজম করতে পারে না।তাই আপনার শিশুর খাবারের গঠন,রঙ,ও স্বাদের বৈচিত্রময় দুনিয়ায় প্রবেশ করতে হবে সাবধানে এবং ধীরে ধীরে।