গর্ভধারণের তৃতীয় মাসের ডায়েট(9-12 সপ্তাহ)

গর্ভধারণের তৃতীয় মাসের ডায়েট(9-12 সপ্তাহ)

গর্ভধারণেরর তৃতীয় মাসটি (9-12 সপ্তাহ)একটা কঠিণ সময় হয়ে ওঠে হবু মায়েদের কাছে কারণ মর্নিং সিকনেস, অবসাদ এবং মেজাজের পরিবর্তন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।সব থেকে বেশী গর্ভপাতের ঘটনা এই সময়েই ঘটে থাকার রিপোর্ট দেখা যায়।এই জন্য হবু মায়েদের চাপমুক্ত হয়ে থাকাটা খুব জরুরী।তাকে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে তার গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি এবং বিকাশ যাতে ঠিকমত হয়।গর্ভদশার তৃতীয় মাসটি গর্ভস্থ ভ্রূণের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।

গর্ভধারণের তৃতীয় মাসের ডায়েটকি খাবার খাবেন

আপনার গর্ভদশার প্রথম ত্রৈমাসিকে আপনাকে সমস্ত ধরণের পুষ্টি যুক্ত খাবার খেতে হবে যাতে গর্ভস্থ ভ্রূণটি একটি সুস্থ শিশুতে পরিণত হয়।আপনি কি ভেবে পাচ্ছেন না গর্ভধারণের তৃতীয় মাসে কি কি খেলে আপনার সন্তান স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠবে?এখানে বলা হল কিছু খাবারের কথা যেগুলো আপনি অবশ্যই আপনার গর্ভাবস্থার 3য় মাসের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবেন।

1. ভিটামিন B6 সমৃদ্ধ খাদ্য

গর্ভদশার তৃতীয় মাসের নবম সপ্তাহে মর্নিং সিকনেস চরমে পৌঁছাবে এবং দ্বাদশ সপ্তাহ থেকে তা কমতে শুরু করবে।ভিটামিন B6 বমি বমি ভাব বা বমি কমাতে সাহায্য করে।চর্বিহীন মাংস, পোল্ট্রির ডিম,সাইট্রাস ফল,শিম্বি জাতীয় ফল,সয়াবিন, বাদাম,বীজ এবং আভাকাডা হল ভিটামিন B6 সমৃদ্ধ খাদ্যের উদাহরণ।

2. ফোলেটযুক্ত খাদ্য

ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড আপনার শিশুর মস্তিষ্ক এবং সুষুম্না কান্ডের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।আপনি যদি ফলিক অ্যাসিড এর সাপ্লিমেন্ট খেয়েও থাকেন তা সত্বেও আপনি আপনার খাদ্য তালিকায় প্রাকৃতিক খাদ্য সমূহ যেগুলোতে ফলিক অ্যাসিড আছে সেগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করবেন।ফোলেট সমৃদ্ধ খাদ্যগুলো হল ব্রকোলি,সাইট্রাস ফল,( বিভিন্ন লেবু)বিনস,মটর,আভাকাডা,ব্রাসেলস স্প্রাউট,ওক্রা,সবুজ শাক সবজি যেমন পালং শাক,কপি প্রভৃতি।

3. ওমেগা 3 সমৃদ্ধ খাদ্য

শিশুর চোখ এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।সয়াবিন, ক্যানোলা তেল,আখরোট, চিয়া বীজ, শণ বীজ, স্যালমন,ম্যাকারেল সার্ডিনন এবং ধানে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।

4. তাজা ফল

তাজা ফলে প্রচুর পরিমাণে নানা রকম পুষ্টি পদার্থ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা শিশুর স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির এবং বিকাশের জন্য অপরিহার্য।ক্যানে প্রক্রিয়াজাত ফলের রস,ঠাণ্ডা করা সংরক্ষিত ফল এবং ফ্রুট জুসের তুলনায় তাজা ফলগুলি অনেক বেশী পুষ্টির উৎস। আপনার খাদ্যের সাথে প্রচুর পরিমাণে খরমুজ, আভাকাডা, ডালিম, কলা, পেয়ারা, কমলালেবু,মিষ্টি লেবু,স্ট্রবেরী প্রভৃতি অন্তর্ভূক্ত করুন।

5. শাকসবজি

তিন মাসের গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্যকর খাদ্যে প্রতিদিন অন্তত কমপক্ষে তিন কাপ করে সবজি যোগ করা উচিত।বিভিন্ন রঙের সবজি পছন্দ করে সেগুলিকে একত্রে মিশিয়ে নিয়ে আপনার যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি এবং স্বাদ পাওয়াকে সুনিশ্চিত করুন।উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আপনার খাদ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করুন পাতা কপি,পালং শাক, ব্রকলি,মিষ্টি আলু,টমেট,গাজর,কুমড়ো,বেল মরিচ,ভুট্টা,বেগুন,সজনে ডাটা ইত্যাদি।

6. শর্করা জাতীয় খাদ্য

কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা আমাদের শরীরে শক্তি প্রদানকারী উৎস।জটিল শর্করাগুলি যে সকল খাদ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সেগুলি হল সম্পূর্ণ শস্য বা হোল গ্রেইন,শিম্বি এবং স্টার্চি সবজিগুলি যেমন আলু,মিষ্টি আলু আমাদের দেহে ভিতর ভাঙতে এবং বিপাক হতে দীর্ঘ সময় নেয়।এটি শক্তির পরিমাণের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।সাধারণ কার্বোহাইড্রেটের প্রাকৃতিক উৎসগুলি হল ফল এবং সবজি যেগুলির মধ্যস্থ তন্তু বা ফাইবার গুলিও আপনার বাড়ন্ত সন্তানের জন্য ভাল।কিছু প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন ময়দা,কুকি, কেক এগুলির প্রতি খাবার সাধারণ ইচ্ছেগুলিকে এড়িয়ে চলুন।এগুলিতে শুধুমাত্র ফাকা ক্যা্লোরি থাকে এবং শিশুদের জন্যও খারাপ।

শর্করা জাতীয় খাদ্য

7. প্রোটিন

প্রোটিন হল দেহের DNA ,কলা এবং পেশী গঠনকারী উপাদান।এগুলি আবার আমাদের শরীরে উৎসেচকের সৃষ্টির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।অতএব ভ্রূণের সঠিক বিকাশের জন্য প্রোটিন অপরিহার্য।প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে অন্তর্ভূক্ত প্রোটিনের উদাহরণ গুলি হল কাওন (এক ধরণের চাল বিশেষ),বীজ,মসূর ডাল,মুরগীর মাংস,বাদাম,নাট বাটার,মাংস এবং সয়াবিন।

8. দুগ্ধজাত পণ্য

দুগ্ধজাত পণ্য গুলি ক্যালসিয়ামের একটা দূর্দান্ত উৎস যেগুলি স্বাস্থ্যকর এবং শক্তিশালী হাড়ের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।দুধ সহ অন্যান্য উদাহরণগুলি হল দই এবং শক্ত বা কঠিন চীজ।আপনার যদি দুগ্ধজাত পণ্যে এলার্জির প্রবণতা থাকে তবে খাবারের সাথে সংযুক্ত করুন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অন্যান্য খাদ্য উৎস গুলি যেমন পাতা কপি,জলজ শালুক এবং সার্ডিন।

9. ভিটামিন D

রোগ প্রতিরধক ব্যবস্থাপনায়,স্বাস্থ্যকর দাঁতের গঠন, হাড়ের বিকাশ এবং শিশুর স্বাস্থ্যকর কোষ বিভাজনেরর ক্ষেত্রে ভিটামিন D একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।ভিটামিন D সমৃদ্ধ খাবার গুলির উদাহরণ হল ফ্যাট যুক্ত মাছ যেমন স্যালমন,ম্যাকরেল এবং টুনা,ডিমের কুসুম,কড লিভার অয়েল এবং ভিটামিন D যুক্ত দুধ অথবা দানা শস্য।

10. জিঙ্ক

রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা এবং স্নায়ু তন্ত্র বিকাশের জন্য একটি অপরিহার্য স্বাস্থ্যকর খনিজ হল জিঙ্ক।খাদ্যে অন্তর্ভূক্ত জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার গুলি হল গরুর মাংস,পালং শাক,গমের বীজ,মাশরুম,ঝিনুক,ভেড়ার মাংস,কুমড়ো এবং স্কোয়াশ বীজ,চিকেন,বাদাম এবং বিনস।

গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে কোন ধরনের খাবার এড়িয়ে চলবেন

এগুলি হল সেই সকল খাদ্য যেগুলিকে গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে এড়িয়ে চলা উচিত।

1. সামুদ্রিক খাবার

সামুদ্রিক খাবারে এবং সমুদ্রের মাছে উচ্চ মাত্রায় মিথাইল মার্কারি থাকে যা ভ্রূণের মস্তিষ্কের মধ্যে বিরূপ ক্রিয়ার কারণ।সুতরাং সামুদ্রিক খাবার গুলিকে এড়িয়ে মিষ্টি জলের মাছগুলির সাথে সংলগ্ন থাকুন।

2. কাঁচা ডিম এবং অপাস্তুরাইজড দুগ্ধজাত পণ্য

কাঁচা ডিমের মধ্যে থাকে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া যা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ।আর অপাস্তুরাইজড দুগ্ধজাত পণ্য যেমন সফট চীজের মধ্যে লিস্টারিয়া থাকতে পারে যেটি আবার গুরুতর খাদ্য বিষক্রিয়ারও কারণ।সুতরাং কাঁচা ডিম এবং অপাস্তুরাইজড দুগ্ধজাত পণ্যগুলি এড়িয়ে চলুন।

3. কাঁচা অথবা কম রান্না করা মাংস

কাঁচা অথবা কম রান্না করা মাংসে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে যা খাদ্য বিষক্রিয়া এবং বাড়ন্ত শিশুর গুরুতর ক্ষতির কারণ।

4. ভিটামিন A

অত্যাধিক পরিমাণে ভিটামিন A জন্মগত ত্রুটির সাথে সংযুক্ত।যে সকল প্রাকৃতিক খাদ্যগুলির মধ্যে ভিটামিন A পাওয়া যায় সেগুলি হল ফল,সবজি,ডিম এবং দুধ, এগুলি ক্ষতিকারক নয়।যাইহোক,গরুর মাংসের,মুরগীর মাংসের অথবা বাছুরের মাংসের যকৃতে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন A থাকে।এই অবস্থায় আপনি একবারে একসঙ্গে অতিরিক্ত ভিটামিন A খাবেন না সেটি নিশ্চিত করার জন্য এগুলিকে এড়িয়ে চলাই ভাল।এছাড়াও ভিটামিন A এর সম্পূরকগুলিও গ্রহণ করা এড়িয়ে চলুন।

5. ক্যাফিন

চা,কফি এবং বাতাণ্বিত পানীয়ে উপস্থিত ক্যাফিন অমরা বা প্ল্যাসেন্টাকে অতিক্রম করতে পারে এবং শিশুর হৃদ স্পন্দনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে।সুতরাং এটিকে সীমিত করা অথবা এড়িয়ে চলাই ভাল।

ক্যাফিন

6. রাস্তার খাবার

রাস্তার খাবার খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমণ যেমন গ্যাস্ট্রোএন্টারাটাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।এই সংক্রমণ গুলি শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে ক্ষতি করবে।সুতরাং রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলাই হল সবথেকে ভাল উপায়।

7. ক্যান অথবা টিনে প্রক্রিয়াজাত খাবার

ক্যানে প্রক্রিয়াজাত খাবার গুলির মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রিজারভেটিভ যা ভ্রূণের বিকাশের ক্ষতি করতে পারে।এছাড়াও এগুলির মধ্যে বিসফেনল A (BPA) নামক একটি রাসায়নিক থাকে যা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াবার সাথেও সম্পর্কিত ।অতএব ক্যান অথবা টিনে প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলিকে এড়িয়ে চলুন এবং তাজা উপাদানগুলির দ্বারা ঘরে প্রস্তুত রান্না করা খাবারই খান।

গর্ভধারণের তৃতীয় মাসের ডায়েটের পরামর্শ

  • হাইড্রেট থাকুনপর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন।আপনি জুস অথবা স্যুপ খেতে পারেন কিন্তু হাইড্রেশন বা জলয়োজনের জন্য জলই সবচেয়ে ভাল।
  • প্রতি দিন আপনার খাদ্যে কমপক্ষে 5 টি ভাগে ফল এবং সবজি পরিবেশন করুন।
  • দিনে 3 বার একসাথে বেশী পরিমাণ খাবারের পরিবর্তে 5 থেকে 6 বারে ভাগ করে অল্প অল্প করে সম পরিমাণ স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
  • সম্পূর্নরূপে অ্যালকোহল,তামাক এবং ড্রাগ গুলিকে এড়িয়ে চলুন যেহেতু এগুলি আপনার সন্তানের গুরুতর জন্মগত ত্রুটি এবং বিকাশের সমস্যার কারণ হয়ে থাকে।
  • আপনার ডাক্তারনির্ধারিত পুষ্টির সম্পূরকগুলিকে কোনোরকম ব্যর্থতা ছাড়াই গ্রহণ করুন।
  • আপনার ডাক্তারের কাছে প্রথমে চেক না করিয়ে আপনার ডায়েট সংশোধন করা এড়িয়ে চলুন।

আপনার গর্ভধারণের তৃতীয় মাসটিতে বমি বমি ভাবটি কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে এবং এই সময়ে বমি হওয়ার প্রবণতাটিও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।যাইহোক,মর্নিং সিকনেসটি কমতে শুরু করে 12 তম সপ্তাহ থেকে এবং সম্পূর্ন রূপে কমে যায় দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের শুরুর দিকে।আপনার শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ এবং সুস্থভাবে বৃদ্ধির এবং স্বাস্থ্যকর বিকাশের জন্য উৎসাহিত হয়ে এই নিবন্ধে আলোচিত ডায়েটের পরামর্শগুলি অনুসরণ করুন।