গর্ভাবস্থায় আদা চা সেবন

গর্ভাবস্থায় আদা চা সেবন

আপনি যখন গর্ভবতী হন আপনার দেহে প্রচুর পরিবর্তন ঘটে, হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে আপনার দেহে হঠাৎ করেই খুব দুর্বলতা অনুভূত হয়, এর অর্থ হল আপনি ছোটখাট সমস্যাগুলির দ্বারা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একসময় স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত বস্তুগুলিরও পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।আপনি গর্ভবতী হলে আপনার জীবনের পুনর্বিবেচনা করার মত একটি অন্যতম মূল বিষয় হল আপনার ডায়েট।আপনি এই সময় যা খান বা পান করেন তা আপনার এবং আপনার সন্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর সেই কারণেই আমরা জানাতে চলেছি গর্ভাবস্থায় আদা চা সেবনের উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি সংক্রান্ত সব কিছু।

গর্ভাবস্থায় আদা চা পান করা কি নিরাপদ?

গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে আদা চা-এর উপকারিতাগুলি বোঝার জন্য, আমাদের অবশ্যই প্রথমে এটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে এটি নিরাপদ কিনা এবং কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি নিরাপদ।যে সকল মহিলা গর্ভবতী তাদের ক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায়, আদা চা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর এবং সহায়ক হিসেবে বিবেচিত, বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে, যখন প্রাতঃকালীন অসুস্থতা বা মর্নিং সিকনেশের জন্য এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে।গর্ভাবস্থায় আপনাকে প্রতি দিন 1 গ্রামের অধিক পরিমাণ আদা সেবনের প্রস্তাব দেওয়া হয় না আর স্বাভাবিক ক্ষেত্রে আপনাকে প্রত্যহ 1.2 গ্রামের অধিক মাত্রা অতিক্রম না করারই সুপারিশ করা হয়।অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে কিছু গর্ভবতী মহিলার তাদের গর্ভাবস্থায় আদা থেকে অ্যালার্জি হতে পারে, মাত্রাতিরিক্ত সেবন ছাড়া এটি হল একমাত্র সময় যখন আদা চা সেবন করাকে অনিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আদা চা-এর উপকারিতাগুলি

গর্ভাবস্থায় আদা এবং আদা চায়ের একাধিক উপকারিতা রয়েছে, এখানে তার কয়েকটি আলোচিত হলঃ

1.মর্নিং সিকনেস বা প্রাতঃকালীন অসুস্থতায় সহায়তা করে

পরিপাক নালী এবং শ্বাস নালীর একটি প্রাকৃতিক বল বৃদ্ধিকারী হিসেবে আদা বিবেচিত।উপরন্তু গলার উপর এর একটি প্রশমনকারী প্রভাব রয়েছে এবং বমি হওয়া প্রতিরোধে সহায়ককারী হিসেবে পরিচিত।সংক্ষেপে বলা ভাল, এমন অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা গর্ভাবস্থাকালীন বমি বমি ভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য আদা চা সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রাত্রে এবং ঘুম থেকে ওঠার ঠিক পরেই আদা চা সেবন করলে তা মর্নিং সিকনেসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সহায়তা করতে পারে।

2.হজমে সহায়তা করে

মর্নিং সিকনেসের মতই, অধিকাংশ ডাক্তারই আদা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, হজম ক্রিয়ার উপর এর ইতিবাচক প্রভাব থাকার কারণে।আপনার অনাক্রম্যতা আপনার হজম ক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তুলবে, তবে এক গ্লাস আদা চা পান করলে তা আপনাকে আপনার দেহের হজম ক্রিয়াকে উন্নত করতে এবং শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।

3. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারকে উন্নত করে

আদা এমন কিছু বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ যা আপনার অনাক্রম্যতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য পরিচিত।গর্ভবতী থাকাকালীন আপনার খাদ্য এবং চায়ের সাথে যুক্ত করার একটি দুর্দান্ত উপকরণ হিসেবে এটি বিবেচিত কারণ এটি বিভিন্ন রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করে এবং অসুস্থতা রোধ করে।

4.গলাকে প্রশমিত করে

এটি একটি সাধারণ জ্ঞান যে, আদা মধ্যস্থ এর প্রশমনকারী বৈশিষ্ট্যের ফলে গলা ব্যথা কমাতে আদা ব্যবহার করা হয় এবং এটি গলায় সংক্রমণ হ্রাস করতেও সহায়ককারী হিসেবে কাজ করে।

5.দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ কাটাতে সাহায্য করে

আদার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা মস্তিষ্ককে শিথিল করে এবং দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে এনে তা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হিসেবে পরিচিত।সীমিত মাত্রায় আদা চা আপনাকে হালকা হয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে।

6.রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে

আদা খনিজ সমৃদ্ধ একটি মূলজ উদ্ভিজ্জ যা আপনার রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে যখন পরিমিত পরিমাণে সেবন করা হয়।

7.কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে

রক্ত শর্করার মতই আদা মধ্যস্থ খনিজগুলি আবার আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখে, কোলেস্টেরলের স্বাস্থ্যকর মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তার জন্য হৃদ স্বাস্থ্য সুরক্ষিত ডায়েটের পাশাপাশি সীমিত পরিমাণে আদা সেবনেরও পরামর্শ আপনাকে দেওয়া হয়।

8.ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

আদার মধ্যে থাকে বিভিন্ন খনিজ যা অক্সিডেটিভ চাপ প্রতিরোধ করে এবং পরিণামস্বরূপ ওভারিয়ান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং তা প্রতিরোধে সহায়তায় করে।

9. মাংস পেশীর পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে

মাংস পেশীর পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে

আদার প্রশমনকারী প্রকৃতিটি আবার মাংসপেশীর ক্লান্তি থেকে আপনার দেহকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে, গর্ভাবস্থায় এক কাপ আদা চা সেবন করলে তা অত্যধিক পরিশান্ত হয়ে যাওয়া থেকে আপনার জয়েন্ট বা সন্ধিগুলি, অস্থি সমূহ এবং দেহকে পুনরুদ্ধার করে এবং শিথিল করে তুলতে সহায়তা করে।

10. পুষ্টি উপাদানগুলির শোষণে উন্নতি ঘটায়

আদা একাধিক ভিটামিন এবং খনিজে সমৃদ্ধ যা আপনার শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এই সকল ভিটামিনগুলির একটি ভাল ভারসাম্য আপনার দেহকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলি আরও ভালভাবে শোষণে সহায়তা করে।আদা চা সেবন করলে তা এই সকল ভিটামিনগুলির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে এবংপরিণামস্বরূপ, এটিপুষ্টি উপাদানগুলিরশোষণেব্যাপকভাবেউন্নটি ঘটায়।

গর্ভবতী থাকাকালীন আপনি কতটা আদা চা সেবন করতে পারেন?

সংযমের সাথে গ্রহণ করলে আদা একটি সুপার খাদ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু যদি অত্যধিক পরিমাণে সেবন করা হয়, এটি আপনার সহায়তা করার বদলে বেশি মাত্রায় ক্ষতি করে ফেলে।বেশিরভাগ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা একজন গর্ভবতী মহিলাকে প্রতিদিন যেকোনওভাবেই এক গ্রামের বেশি আদা সেবনের পরামর্শ দেন না।এর অর্থ হল আপনার চায়ে অতিরিক্ত আদার পরিমাণে সীমাবদ্ধতা এনে সেটিকে প্রতিদিন এক গ্রামে করুন এবং আদা চায়ের পুষ্টিগুণের মাত্রা সর্বোচ্চ করে তুলতে সেই চায়ের সাথে আরও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর উপকরণগুলি যোগ করুন।

অত্যধিক পরিমাণে আদা চা খেয়ে ফেলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি

নিয়মিত ভিত্তিতে যদি অত্যধিক পরিমাণে আদা চা খেয়ে ফেলা হয় তবে তা কিছু বড়সড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, এখানে তার কয়েকটির উল্লেখ করা হলঃ

1.গর্ভাবস্থার ওজন হ্রাস

যখন অত্যধিক মাত্রায় সেবন করা হয়, আদা ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে গর্ভাবস্থায় একটা ক্ষতিকারক পরিমাণে ওজন হ্রাস পাওয়া, যা আপনার এবং আপনার শিশুর ক্ষেত্রে পুষ্টির একটি ভারসাম্যহীনতা গড়ে তুলতে পারে।

2.অ্যানাস্থেসিয়া এবং অতিরিক্ত রক্ত ক্ষয়ের সাথে মিথোস্ক্রিয়া

আদায় রয়েছে রক্ত তরলীকরণের বৈশিষ্ট্যাবলী, এটি রক্ত জমাট বাঁধায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং অত্যধিক রক্ত ক্ষয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে, এছাড়াও আরও অতিরিক্তভাবে যদি চরম অত্যধিক মাত্রায় আদা সেবন করা হয় তবে তা অ্যানাস্থেসিয়া বা অসাড়তার সাথে বাজে ভাবে মিথোস্ক্রিয়া করে যা অস্ত্রপচারের আগে সেবন করাকে বিপজ্জনক করে তোলে।

3.জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি

উপরের উল্লেখানুযায়ী, আদা পুষ্টি পদার্থগুলি শোষণে সহায়তা করে, কিন্তু অত্যধিক মাত্রায়, তা একটি খারাপ জিনিস হয়ে উঠতে পারে।আপনারশরীরযদিখাদ্যে উপস্থিতপুষ্টিগুলিঅত্যধিকপরিমাণগ্রহণকরেতবেএটিশিশুর কমপুষ্টির কারণ হতে পারে।

4.গর্ভপাত

অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে, মাত্রারিক্ত আদা সেবনের ফলে তা গর্ভপাত অথবা মৃত সন্তানের জন্মলাভের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

5.অকাল শ্রম

আদার মধ্যে রক্ত তরলীকরণ এবং মাংসপেশী শিথিলকরণের বৈশিষ্ট্য থাকার দরুণ, তা অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে অকাল শ্রমের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

6.কম ওজনের শিশুর জন্ম

জন্মগত ত্রুটির দিক থেকে ভাবলে দেখা যায়, যখন অত্যধিক মাত্রায় আদা সেবন করা হয় তখন তা খাদ্যে উপস্থিত পুষ্টি উচ্চ মাত্রায় আপনার দেহে শোষিত হওয়ার কারণ হয়ে থাকে, আর তার ফলে আপনার সন্তানের মধ্যে কম পুষ্টির কারণও হয়ে ওঠে এই আদাই, যার পরিণামস্বরূপ, জন্মের সময় আপনার শিশুর ওজন প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়ে থাকে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আদা চায়ের সেরা রেসিপিগুলি

এখানে আদা চায়ের কয়েকটি সেরা রেসিপির উল্লেখ করা হলঃ

1.লেবু আদা চা

কম আঁচে বসিয়ে রোজের ব্যবহারের কালো চা ফুটান, এক চা-চামচ আদা কুঁচি করে নিয়ে সেটিকে তার সাথে যোগ করুন, একটি অর্ধেক পাতি লেবুর রস চিপে নিন এবং তার সাথে এক চামচ মধু যোগ করুন।এবার পুদিনা পাতা দিয়ে সেটি গার্নিশ করে নিন।

2.আদা লবঙ্গ চা

ফুটন্ত জলের মধ্যে এক চা-চামচ আদা কুঁচি এবং 3 অথবা 4 টে লবঙ্গ যোগ করে 5 মিনিটের জন্য আঁচ কম করে ফোটাতে থাকুন, এর মধ্যে চা পাতা যোগ করে পুনরায় আরও অতিরিক্ত 3 মিনিট ধরে ফুটান, এবার এক চা-চামচ মধু সহযোগে পরিবেশন করুন।

3.আদা গ্রীন টি

এক চা-চামচ আদা কুঁচি জলের মধ্যে যোগ করুন, এবার সেটিকে 8 মিনিট ধরে কম আঁচে ফোটান।আদার নির্যাস মিশ্রিত এই জলটিকে এবার একটি গ্লাসে্র মধ্যে ঢালুন, এবার এর মধ্যে ডুবানোর জন্য 2 টি গ্রীন টিয়ের টি ব্যাগ নিয়ে গ্লাসের তরলের মধ্যে যোগ করুন, এরপর 3 মিনিট সেটিকে সেই গরমের ভাপে রেখে দিন, তারপর চা পান করার জন্য টি ব্যাগগুলি সরিয়ে নিন।

4.ক্যামোমাইল আদা চা

একটি পাত্রে জল নিয়ে তার মধ্যে এক চা-চামচ আদা কুঁচি যোগ করুন, তারপর সেটিকে কম আঁচে বসিয়ে রেখে ফুটান।এরপর এক চা-চামচ মধুর সাথে সেই তরলটিকে একটি গ্লাসে ঢেলে নিন এবং তার মধ্যে একটি ক্যামোমাইল টি ব্যাগ ডুবান।

5.তুলসী আদা চা

একটি পাত্রে জলের মধ্যে চা পাতার সাথে আদা কুঁচি এবং তুলসী পাতা যোগ করে সেগুলিকে একসাথে ফুটান।এবার পরিবেশনের কাপে সেটিকে ছেঁকে নিয়ে তার মধ্যে পাতি লেবুর রস চিপে নিন এবং মধু যোগ করে সেটিকে ভালভাবে নেড়ে নিয়ে পান করুন।

আদা চা সেবনের পর আপনি যদি অস্থির অথবা অসুস্থ বোধ করেন, আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলুন।আপনার খাদ্য তালিকার সাথে রাখা আদা কখনই অতিরিক্ত পরিমাণে সেবন করবেন না এবং আরও তথ্যের জন্য আপনার পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে আলোচনা করুন ও তার পরামর্শ গ্রহণ করুন।