বাচ্চাদের তাপজনিত ফুসকুড়ি বা ঘামাচি

বাচ্চাদের তাপজনিত ফুসকুড়ি বা ঘামাচি

যখন আপনি কোনো গরম এবং আর্দ্র দেশে বসবাস করেন, তখন তাপজনিত ফুসকুড়ি বেশী হয়। যদিও তাপজনিত ফুসকুড়ি বিরক্তিকর হতে পারে, তবে এটি চিকিৎসাযোগ্য, এবং আপনি সহজে সেগুলি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। শিশুদের তাপজনিত ফুসকুড়ি চিনতে শিখুন এবং কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে জানুন।

তাপজনিত ফুসকুড়ি কী?

তাপজনিত ফুসকুড়িকে মিলিয়ারিয়া রুব্রা, মিলিয়ারিয়া ক্রিস্টালাইন, গ্রীষ্মের ফুসকুড়ি বা ঘামাচিও বলা হয়। নামটি থেকে যেমন বোঝা যায়, তাপজনিত ফুসকুড়ি হ’ল অত্যধিক শরীরের তাপের ফলে আপনার শিশুর ত্বকে দেখা দেওয়া ছোট ফুসকুড়ি। এই ফুসকুড়ির রং লাল।

যে সব জায়গায় ঘামাচিগুলি দেখা যায় তার মধ্যে কয়েকটি হল পেট, বুক, ঘাড়, নিতম্ব এবং কুঁচকি এলাকা। আপনি যদি আপনার শিশুকে টুপি পরান, তাহলে ঘামাচিগুলি কপালের উপর এবং খুলির উপরেও দেখা যেতে পারে। ঘাড়ের উপরও ঘামাচি খুব দেখা যায়। আপনি যদি আপনার শিশুর শরীরে একটিও ঘামাচি দেখতে পান, তাহলে এটির চুলকানি উপশম করতে কিছু করা দরকার।

ঘামাচি কেমন দেখতে হয়?

ঘামাচি কেমন দেখতে হয়?

ঘামাচি হল লাল রঙের ছোট ফুসকুড়ি। এগুলি সাধারণত শরীরের বিভিন্ন অংশে গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবে দেখা যায়।

ঘামাচির কারণ?

আপনার শিশুর খুব ঘাম হলে ঘামাচি দেখা দেবে। অত্যধিক ঘামের কারণে, ত্বকের ছিদ্রগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং ঘাম বেরোতে পারে না। বাচ্চাদের ঘামাচি হয় কারণ তাদের ছিদ্রগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ছোট।

আপনি যদি গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়াঅঞ্নগচলেবাস করেন তবে আপনার শিশুর ঘামাচি হতে পারে। আপনার শিশুর জ্বর থাকলে অথবা আপনি যদি তাকে পোশাকের উপর পোশাক পরিয়ে রাখেন, তাহলে ঘামাচি শীতকালেও দেখা দিতে পারে।

ঘামাচি কি বাচ্চাদের পক্ষে যন্ত্রনাদায়ক?

ঘামাচি সাধারণত শিশুর জন্য বেদনাদায়ক হয় না। এগুলি সাধারণত শুধুমাত্র হালকা অস্বস্তি ঘটায়। তবে, এটি ঘামাচির তীব্রতার উপর নির্ভর করে। যদি ঘামাচিবেশী হয়, তাহলে শিশুটি ক্রমাগত এটিকে খোঁচালে এটি বেদনাদায়ক হতে পারে।

এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে শিশুরা কাঁদা ছাড়া অন্য কোনো ভাবে বোঝাতে পারবে না। এই কারণেই আপনাকে শিশুর ত্বকের প্রতি এবং লক্ষণগুলির প্রতি অবিরত মনোযোগ দিতে হবে যাতে সে কোনো অস্বস্তিতে না থাকে। অত্যাধিক তপ্ত হওয়ার ফলে ভীষণ রকমের ঘামাচি হলে স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।

শিশুদের মধ্যে মিলিয়ারিয়ার লক্ষণ

ঘামাচি বা মিলিয়ারিয়া আপনার শিশুর ত্বকের উপর ক্ষুদ্র লাল ব্রণর মতো দেখতে লাগে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে চুলকানি, খামখেয়ালিপনা এবং কান্নাকাটি করা। চুলকালে বা কাপড়ের ঘর্ষণ লাগলে ঘামাচিগুলিতে জ্বালা করে। একটি গৌণ সংক্রমণও দেখা দিতে পারে, যদিও এটি বিরল।

একটি শিশুর ঘামাচি কিভাবে নির্ণয় করতে হবে?

একটি শিশুর ঘামাচি কিভাবে নির্ণয় করতে হবে?

মিলিয়ারিয়াসহজেইসনাক্তকরাযেতেপারেএবংসাধারণতচিকিৎসারপ্রয়োজনহয়না। তবে, যদিতিনথেকেচারদিনেরমধ্যেঘামাচিনাযায়বাআপনারশিশুরজ্বরহয়, তবেঅবশ্যইডাক্তারকেডাকুন।

আপনার বাচ্চার যদি ফুসকুড়ি থাকে, তবে এই লক্ষণগুলি সম্পর্কে সতর্ক হোন:

  • ফুসকুড়ির চারপাশে অতিরিক্ত লালভাব, ব্যথা, ফুলে যাওয়া, বা উষ্ণ ভাব
  • পুঁজ তৈরি হওয়া
  • জ্বর
  • ঘাড়, হাত বা কুঁচকি এলাকাতে লসিকা গ্রন্থিগুলি ফুলে যাওয়া
  • প্রভাবিত এলাকায় লাল রেখা দেখা দেওয়া

চিকিৎসা

ঘামাচির জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।তবে, লাল ফুসকুড়ির সাথে যুক্ত উপসর্গগুলি থেকে আপনার শিশুকে মুক্তি দিতে আপনি নিম্নলিখিত পদ্ধিগুলি অবলম্বন করতে পারেন:

1. তাপহ্রাসকরুন

আপনার শিশুর পোশাক খুলে দিন বা সেটিকে আলগা করুন। ঘাম থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং ত্বকের ছিদ্রগুলি পরিষ্কার করতে, শীতল জলে শিশুকে স্নান করান। আপনি পরিষ্কার এবং ভেজা তোয়ালে দিয়ে শিশুর দেহ মুছেও দিতে পারেন। এটি ত্বকের তাপমাত্রাও কমিয়ে আনবে।

2. ত্বকশুকনোরাখুন

আপনার শিশুর ত্বক শুকানোর জন্য তোয়ালে ব্যবহার করবেন না। এটি স্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে যেতে দিন এবং শিশুকে ঠান্ডা করার জন্য একটি ফ্যান ব্যবহার করুন।ঘামাচির জন্য মলম বা ক্রিম ব্যবহার করবেন না, যদি না শিশু বিশেষজ্ঞ আপনাকে তা করতে বলেন।

3. ত্বককেশ্বাসনিতেদিন

এটি শিশুর যত্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা অনেক বাবা-মা অবহেলা করেন। আপনার সন্তানের ত্বক যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক বায়ুতে উন্মুক্ত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তাদের নগ্ন রাখুন বা নরম এবং আলগা কিছু পরান।

ঘামাচির জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

আপনি শিশুদের ত্বকের ফুসকুড়ির চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলিও ব্যবহার করতে পারেন:

1. বরফেরকিউব

ফুসকুড়ির উপর বরফের কিউব ঘষলে বিস্ময়কর ফল দিতে পারে। কাপড়ের মধ্যে কিছু বরফের কিউব মুড়ে নিন এবং সেটি দিয়ে ফুসকুড়িগুলির উপর আলগাভাবে চাপুন। অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখবেন না।

2. বেকিংসোডা

বেকিং সোডা এবং জল দিয়ে একটি দ্রবণ বানান। একটি তোয়ালে এই দ্রবণে ডোবান এবং সেটি দিয়ে প্রভাবিত এলাকাটি মুছে দিন। এটি উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণগুলির উপশম করবে। এছাড়া আপনি এক বালতি জলে বেকিং সোডা 1 টেবিল চামচ দিয়ে আপনার শিশুকে স্নান করাতে পারেন।

3. জইচূর্ণ(ওটমিল)

একটি বাথটব ভর্তি জলে এক কাপ ওটমিল (গুঁড়া) যোগ করুন এবং এটি দিয়ে আপনার শিশুকে স্নান করান। আপনি জলে ওটমিল যোগ করলে জলটি দুধের মতো হয়ে যাবে। অবশ্যই জৈব ওটমিল ব্যবহার করবেন এবং প্রিজারভেটিভ যুক্তগুলি ব্যবহার করবেন না। 15-20 মিনিট ধরে আপনার বাচ্চাকে স্নান করান এবং কাপড় দিয়ে মুছিয়ে নিন।

4. চন্দনকাঠেরগুঁড়া

মিষ্টি গন্ধ বেরোবে এমন বিকল্প আছে, সেটি হল চন্দন কাঠের গুঁড়া। এটি আপনার শিশুর ত্বককে ঠান্ডা করে এবং সমস্ত লক্ষণগুলি দূর করতে সহায়তা করে। গোলাপ জল এবং চন্দন কাঠের পাউডার সম পরিমাণে নিয়ে একটি পেস্ট বানান। লক্ষণগুলি হ্রাস করার জন্য ফুসকুড়িগুলির উপর এটি প্রয়োগ করুন। আরেকটি প্রতিকার হল 2 টেবিল চামচ ধনেপাতা গুঁড়া, 2 টেবিল চামচ চন্দন কাঠের পেস্ট, এবং একটু গোলাপ জল মেশানো।

5. ফুলার’সআর্থ

ফুলার’স আর্থ বা মুলতানি মাটি হল আরেকটি চমৎকার ঘরোয়া প্রতিকার যা আপনি ব্যবহার করতে পারেন। আপনাকে যা করতে হবে তা হল ফুলার’স আর্থ এবং গোলাপ জল দিয়ে একটি পুরু পেস্ট বানাতে হবে। তারপরে আপনার বাচ্চার ফুসকুড়িগুলির উপর পেস্টটি প্রয়োগ করুন তাকে চুলকানি থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে।

6. নিম

নিম পাতাগুলিকে পিষে মসৃণ পেস্ট বানান এবং প্রভাবিত অঞ্চলে ঐ পেস্টটি প্রয়োগ করুন। পেস্টটি শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে দিন।

7. ঘৃতকুমারী(অ্যালোভেরা)

অ্যালো ভেরা জেলও ঘামাচি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পরিচিত। যদি আপনার বাড়িতে অ্যালো ভেরা গাছ থাকে, তবে আপনি নিজেই পাতা থেকে জেলটি বের করতে পারেন। আপনি যদি এটি দোকানের স্টক থেকে কেনেন, তবে কোনও প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিক বিহীন জৈব অ্যালো ভেরা জেল কিনতে ভুলবেন না। মুখের পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অংশে শিশুর ঘামাচি উপশম করতে আপনি এই জেলটি নিরাপদে ব্যবহার করতে পারেন।

8. শসা

শসাকে অনেকগুলি লম্বা টুকরা করে কাটুন আপনার শিশুর ত্বকের উপর রেখে দিন। আপনি শশাকে পিষে নিতেও পারেন এবং তাৎক্ষণিক শীতলকরণের জন্য ফুসকুড়িগুলিতে পেস্টটি প্রয়োগ করতে পারেন।

কিভাবে ঘামাচি প্রতিরোধ করতে পারেন?

এখানে কিছু উপায় রয়েছে যা দিয়ে আপনি শিশুদের সাধারণ ঘামাচি প্রতিরোধ করতে পারেন:

  • আপনার বাচ্চাকে সূর্যের তীব্র রশ্মি থেকে দূরে রাখুন। বিশেষ করে চরম তাপের সময়গুলিতে তাদের ঘরের ভিতরেবাতানুকূল কক্ষগুলিতে রাখুন।যখন আপনি তাদের বাইরে নিয়ে আসবেন, তারা যেন একটি ছায়াযুক্ত এলাকায় থাকে। এছাড়াও, আপনার শিশু যেন ভালোমতো হাইড্রেটেড থাকে তা নিশ্চিত করুন।
  • সর্বদা, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, তাদের আরামদায়ক এবং আলগা-মাপের পোশাক পরান। সুতীর পোশাক ব্যবহার করা উচিৎ। সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিকের ডায়পার কভার ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
  • ঘাড়, বগল, এবং কুঁচকির মতো এলাকায় ঘাম বেশী হয়। শীতল জল দিয়ে এই এলাকাগুলি ধুয়ে দিন এবং তারা যেন শুকনো থাকে তা নিশ্চিত করুন।
  • আপনার শিশুর শরীর বেশী তপ্ত হয়ে উঠছে কিনা তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা করুন। যদি তারা ঘামে ভিজে যায় এবং উষ্ণ হয়ে থাকে, তবে তাদের একবার স্নান করাতে হবে বা একটি তোয়ালে দিয়ে মুছে তাদের ত্বক ঠান্ডা করতে হবে।
  • বাচ্চাকে একটি বাতানুকূল যন্ত্র যুক্ত ঘরে ঘুমাতে দিন অথবা তাদের ঘরে ফ্যান লাগান। ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশনারটি যেন আপনার শিশুর দিকে মুখ করে না থাকে। তারা ঘুমানোর সময় যেন শুধু একটি মৃদু হাওয়া পৌঁছায় তা নিশ্চিত করুন।

ক্রান্তীয়, আর্দ্র অঞ্চলে বসবাস করলে ঘামাচি হওয়ার সম্ভাবনা সবসময় বাড়ে। বাচ্চারা যেহেতু খুব ছোট এবং বলতে পারে না, তাই ঘামাচি হওয়া শুরু হলে তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে সক্ষম নাও হতে পারে। বাচ্চাদের গোটা শরীরকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা এবং সতর্ক হওয়া বাবা-মায়ের কর্তব্য। যদি আপনার শিশুর ঘামাচি হয়, তাহলে উপরে দেওয়া পরামর্শগুলি আপনাকে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।